আহকামে সিয়াম
রামাদানের সিয়াম ইসলামের অন্যতম ফরজ ইবাদত। এই প্রবন্ধে আমরা সিয়ামের বিধান
নিয়ে আলোচনা করব। আল্লাহর কত দয়া! ইসলামকে কত সহজ করেছেন। সাহরী খাওয়া
আমাদের নিজেদের জন্যই প্রয়োজন, অথচ আল্লাহ এ কাজটিকে ইবাদত বানিয়ে দিয়েছেন।
খেলে আল্লাহ খুশি হন এবং সাওয়াব দেন। বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ
সা. সাহরী খেতে নির্দেশ দিয়েছেন। এক হাদীসে তিনি বলেন:
السَّحُورُ أَكْلُهُ بَرَكَةٌ فَلا تَدَعُوهُ وَلَوْ أَنْ يَجْرَعَ أَحَدُكُمْ جُرْعَةً مِنْ مَاءٍ فَإِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ وَمَلائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى الْمُتَسَحِّرِينَ
“সাহরী খাওয়া বরকত; কাজেই তোমরা তা ছাড়বে না; যদি এক ঢোক পানি পান করেও হয় তবুও; কারণ যারা সাহরী খায় তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাগণ সালাত (রহমত ও দুআ) প্রদান করেন।” আহমদ, আল-মুসনাদ ৩/১২, ৪৪; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ৮/২৪৫; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২৫৮। হাদীসটি হাসান।
কোনো কোনো হাদীসে সাহরীতে খেজুর খেতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সাহরী খাওয়ার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সা.-এর সুন্নাত ও শিক্ষা হলো একেবারে শেষ মুহূর্তে সাহরী খাওয়া। যাইদ ইবনু সাবিত বলেন:
تَسَحَّرْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ ثُمَّ قُمْنَا إِلَى الصَّلاةِ قُلْتُ كَمْ كَانَ قَدْرُ مَا بَيْنَهُمَا قَالَ خَمْسِينَ آيَةً
“আমরা রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে সাহরী খেলাম এরপর ফজরের সালাতে দাঁড়ালাম। যাইদকে জিজ্ঞাসা করা হলো, মাঝে কতটুকু সময় ছিল? তিনি বলেন ৫০ আয়াত তিলাওয়াতের মত।” বুখারী আস-সহীহ ২/৬৭৮; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭৭১।
রাসূলুল্লাহ সা.-এর সুন্নাত সুর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা। তিনি এত তাড়াতাড়ি ইফতার করতেন যে, অনেক সময় সাহাবীগণ বলতেন, হে আল্লাহর রাসূল, সন্ধ্যা হোক না, এখনো তো দিন শেষ হলো না! তিনি বলতেন, সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই ইফতার করতে হবে। বিভিন্ন হাদীসে রয়েছে যে, সাহাবীগণ সর্বদা শেষ সময়ে সাহরী খেতেন এবং সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করতেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
لا يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ
“যতদিন মানুষ সুর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে তাড়াতাড়ি ইফতার করবে ততদিন তারা কল্যাণে থাকবে।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৬৯২; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭৭১।
إِنَّا مَعْشَرَ الأَنْبِيَاءِ أُمِرْنَا بِتَعْجِيْلِ فِطْرِنَا وَتَأْخِيْرِ سُحُوْرِنَا
“আমরা নবীগণ আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রথম সময়ে ইফতার করতে ও শেষ সময়ে সাহরী খেতে।” হাইসামী, মাজামউয যাওয়াইদ২/১০৫, ৩/১৫৫। হাদীসটির সনদ সহীহ।
ইফতারের জন্য রাসূলুল্লাহ সা.-এর নির্দেশ হলো খেজুর মুখে দিয়ে ইফতার করা। তিনি সম্ভব হলে গাছ পাকা টাটকা রুতাব খেজুর, না হলে খুরমা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। খেজুর না পেলে তিনি পানি মুখে দিয়ে ইফতার করতেন। তিনি ইফতারিতে তিনটি খেজুর খেতে পছন্দ করতেন। যিয়া মাকদিসী, আল-মুখতারাহ ৫/১৩১-১৩২; হাইসামী, মাজমাউয ৩/১৫৫-১৫৬। এ বিষয়ে অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
সাহরীর সময় রোযাদারদের ডাকা মুসলিম উম্মাহর একটি বরকতময় রীতি। বর্তমানে প্রত্যেক মসজিদে মাইক থাকার কারণে বাড়ি বাড়ি বা মহল্লার মধ্যে যেয়ে ডাকার রীতি উঠে গিয়েছে। মসজিদের মাইক থেকেই ডাকা হয়। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, ডাকার উদ্দেশ্য যারা সাহরী খেতে চান তাদেরকে ঘুম ভাঙ্গতে সাহায্য করা। এজন্য ফজরের আযানের ঘন্টাখানেক আগে কিছু সময় ডাকাডাকি করাই যথেষ্ট। বর্তমানে অনেক মসজিদে শেষ রাতে একদেড় ঘন্টা একটানা গজল-কিরাআত পড়া হয় ও ডাকাডাকি করা হয়। বিষয়টি খুবই নিন্দনীয় ও আপত্তিকর কাজ। অনেকেই সাহরীর এ সময়ে খাওয়ার আগে বা পরে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করেন, বা তিলাওয়াত করেন, কেউ বা সাহরী খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন, কারণ সকালে তার কাজ আছে, অনেক অসুস্থ মানুষ থাকেন। এরা সকলেই এরূপ একটানা আওয়াজে ক্ষতিগ্রস্থ হন। বান্দার হক্কের দিকে আমাদের বিশেষ লক্ষ্য রাখা দরকার।
সাহরী ও ইফতার খাওয়ার অর্থ এ নয় যে, সারাদিন যেহেতু খাব না, সেহেতু এ দু সময়ে দ্বিগুণ খেয়ে সারাদিন জাবর কাটব! এরূপ খেলে তো সিয়ামের মূল উদ্দেশ্যই নষ্ট হলো। সাহরী ও ইফতার খাওয়ার অর্থ স্বাভাবিকভাবে আমরা যা খাই তা খাওয়া। সমাজে প্রচলিত আছে যে, সাহরী ও ইফতারীতে বা রামাদানে যা খাওয়া হবে তার হিসাব হবে না। এজন্য আমরা রামাদান মাসকে খাওয়ার মাস বানিয়ে ফেলেছি। বস্তুত, হিসাব হবে কি না তা চিন্তা না করে, সাওয়াব কিসে বেশি হবে তা চিন্তা করা দরকার। রামাদান মাস মূলত খাওয়ানোর মাস। দুভাবে খাওয়ানোর নির্দেশ রয়েছে হাদীসে। প্রথমত দরিদ্রদেরকে খাওয়ানো এবং দ্বিতীয়ত রোযাদারকে ইফতার খাওয়ানো। রোযা অবস্থায় দরিদ্রকে খাওয়ানোর ফযীলত আমরা অন্য খুতবায় জেনেছি। আর ইফতার করানোর বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ غَيْرَ أَنَّهُ لا يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الصَّائِمِ شَيْئًا
“যদি কেউ কোনো রোযাদারকে ইফতার করায়, তাহলে সে উক্ত রোযাদারের সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে, তবে এতে উক্ত রোযাদারের সাওয়াব একটুও কমবে না।” তিরমিযী, আস-সুনান ৩/১৭১। তিরমিযী বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ।
ইফতার করানো অর্থ আনুষ্ঠানিকতা নয়। দরিদ্র সাহাবী-তাবিয়ীগণ নিজের ইফতার প্রতিবেশীকে দিতেন এবং প্রতিবেশীর ইফতার নিজে নিতেন। এতে প্রত্যেকেই ইফতার করানোর সাওয়াব পেলেন। অনেকে নিজের সামান্য ইফতারে একজন মেহমান নিয়ে বসতেন। আমাদের সকলেরই চেষ্টা করা দরকার নিয়মিত নিজেদের খাওয়া থেকে সামান্য কমিয়ে অন্যদেরকে ইফতার করানো। বিশেষত দরিদ্র, কর্মজীবি, রিকশাওয়ালা অনেকেই কষ্ট করে রোযা রাখেন এবং ইফতার করতেও কষ্ট হয়। সাধ্যমত নিজেদের খাওয়া একটু কমিয়ে এদেরকে খাওয়ানো দরকার।
হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, রামাদান মাসে যারা সিয়াম পালন করেন তাদের দুটি শ্রেণী রয়েছে। এক শ্রেণীর পূর্ববর্তী সকল গোন্হা ক্ষমা করা হবে। অন্য শ্রেণী ক্ষুধা-পিপাসায় কষ্ট করা ছাড়া কিছুই লাভ হবে না। প্রথম শ্রেণীর রোযাদারদের বিষযে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
“যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং আল্লাহর নিকট সাওয়াব অর্জনের খাঁটি নিয়্যাতে রামাদানের সিয়াম পালন করবে তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে।” বুখারী, আস-সহীহ ১/২২, ২/৬৭২, ৭০৯; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৫২৩।
দ্বিতীয় শ্রেণীর রোযাদারদের বিষয়ে তিনি বলেন:
رُبَّ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهِ إِلاَّ الْجُوعُ وَرُبَّ قَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ قِيَامِهِ إِلاَّ السَّهَرُ
“অনেক সিয়াম পালনকারী আছে যার সিয়াম থেকে শুধু ক্ষুধা ও পিপাসা ছাড়া আর কোন লাভ হয় না। এবং অনেক কিয়ামকারী বা তারাবীহ-তাহাজ্জুদ পালনকারী আছে যাদের কিয়াম-তারাবীহ থেকে শুধু রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কোনোই লাভ হয় না।” ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৫৩৯; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২৬২। হাদীসটি সহীহ।
এরূপ রোযাদারদের প্রতি বদদোয়া করে তাদের দুর্ভাগ্যের কথা জানিয়ে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
بَعُدَ مَنْ أَدْرَكَ رَمَضَانَ فَلَمْ يُغْفَرْ لَهُ
“যে ব্যক্তি রামাদান মাস পেল, কিন্তু এই মাসে তাকে ক্ষমা করা হলো না সেই ব্যক্তি আল্লাহর রহমত থেকে চির-বঞ্চিত বিতাড়িত।” হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/১৭০; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ২/১৪০-১৪১; আলবানী সহীহুত তারগীব ১/২৬২। হাদীসটি সহীহ।
আমরা যারা রামাদানের সিয়াম পালন করতে যাচ্ছি তাদের একটু ভাবতে হবে, আমরা কোন্ দলে পড়ব। আর তা জানতে হলে রোযা বা সিয়ামের অর্থ বুঝতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
لَيْسَ الصِّيَامُ مِنَ الأَكْلِ وَالشُّرْبِ إِنَّمَا الصِّيَامُ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ
“পানাহার বর্জনের নাম সিয়াম নয়। সিয়াম হলো অনর্থক ও অশ্লীল কথা-কাজ বর্জন করা।” ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ৮/২৫৫; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৫৯৫; আলবানী, সহীহহুত তারগীব ১/২৬১। হাদীসটি সহীহ।
তাহলে চিন্তাহীন, অনুধাবনহীন, সৎকর্মহীন পানাহার বর্জন “উপবাস” বলে গণ্য হতে পারে তবে ইসলামী “সিয়াম” বলে গণ্য হবে না। হারাম বা মাকরূহ কাজেকর্মে রত থেকে হালাল খাদ্য ও পানীয় থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখার নাম সিয়াম নয়। সিয়াম অর্থ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সকল হারাম, মাকরূহ ও পাপ বর্জন করার সাথে সাথে হালাল খাদ্য, পানীয় ও সম্ভোগ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। এভাবে হৃদয়ে সার্বক্ষণিক আল্লাহ সচেতনতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে লক্ষ্য রেখে শত প্রলোভন ও আবেগ দমন করে সততা ও নিষ্ঠার পথে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য সিয়াম। যদি আপনি কঠিন ক্ষুধা বা পিপাসায় কাতর হয়েও আল্লাহর ভয়ে ও তাঁর সন্তুষ্টির আশায় নিজেকে খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত রাখেন, অথচ সামান্য রাগের জন্য গালি, ঝগড়া ইত্যাদি হারাম কাজে লিপ্ত হন, মিথ্যা অহংবোধকে সমুন্নত করতে পরনিন্দা, গীবত, চোগলখুরী ইত্যাদি ভয়ঙ্কর হারামে লিপ্ত হন, সামান্য লোভের জন্য মিথ্যা, ফাঁকি, সুদ, ঘুষ ও অন্যান্য যাবতীয় হারাম নির্বিচারে ভক্ষণ করেন, তাহলে আপনি নিশ্চিত জানুন যে, আপনি সিয়ামের নামে আত্মপ্রবঞ্চনার মধ্যে লিপ্ত আছেন। ধার্মিকতা ও ধর্ম পালনের মিথ্যা অনুভতি ছাড়া আপনার কিছুই লাভ হচ্ছে না। রাসলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ وَالْجَهْلَ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ
“যে ব্যক্তি পাপ, মিথ্যা বা অন্যায় কথা, অন্যায় কর্ম, ক্রোধ, মূর্খতাসুলভ ও অজ্ঞতামুলক কর্ম ত্যাগ করতে না পারবে, তার পানাহার ত্যাগ করাতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৬৭৩, ৫/২২৫১।
আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, তোমরা রোযার সময় দিবসে পানাহার করো না। এর পরের আয়াতেই আল্লাহ বললেন, তোমরা অপরের সম্পদ অবৈধভাবে “আহার” করো না। এখন আপনি প্রথম আয়াতটি মেনে দিবসে আপনার ঘরের খাবার আহার করলেন না, কিন্তু পরের আয়াতটি মানলেন না, সুদ, ঘুষ, জুলুম, চাঁদাবাজি, যৌতুক, মিথ্যা মামলা, যবর দখল, সরকারি সম্পত্তি অবৈধ দখল ইত্যাদি নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে অন্যের সম্পদ “আহার” করলেন, তাহলে আপনি কেমন রোযাদার?
একটি বিশেষ “আহার” হলো “গীবত”। “গীবত” শতভাগ সত্য কথা। যেমন লোকটি বদরাগী, লোভী, ঘুমকাতুরে, ঠিকমত জামাতে নামায পড়ে না, অমুক দোষ করে, কথার মধ্যে অমুক মুদ্রা দোষ আছে ইত্যাদি। এরূপ দোষগুলি যদি সত্যই তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে তবে তার অনুপস্থিতিতে তা অন্য কাউকে বলা বা আলোচনা করা “গীবত”। আল্লাহ বলেছেন, গীবত করা হলো মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়া। মৃতভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করার মতই “গীবত” করা সর্ববস্থায় হারাম। উপরন্তু সিয়ামরত অবস্থায় গীবত করলে “মাংস খাওয়ার” কারণে সিয়াম নষ্ট হবে বা সিয়ামের সাওয়াব সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে।
সিয়াম শুধু বর্জনের নাম নয়। সকল হারাম ও মাকরূহ বর্জনের সাথে সাথে সকল ফরয-ওয়াজিব ও যথাসম্ভব বেশি নফল মুস্তাহাব কর্ম করাই সিয়াম। বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায় যে, রামাদান মাসে নফল-ফরয সকল ইবাদতের সাওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এজন্য সকল প্রকার ইবাদতই বেশি বেশি আদায় করা দরকার। সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রামাদান মাসে উমরা আদায় করা রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে হজ্জ করার সমতুল্য। যদি কেউ রোযা অবস্থায় দরিদ্রকে খাবার দেয়, অসুস্থ মানুষকে দেখতে যায় এবং জানাযায় শরীক হয় তবে সে ব্যক্তিকে আল্লাহ জান্নাত দান করবেন। এ ছাড়া হাদীসে রামাদানে বেশি বেশি তাসবীহ, তাহলীল, দুআ ও ইসতিগফারের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন যে, রোযা অবস্থার দুআ ও ইফতারের সময়ের দুআ আল্লাহ কবুল করেন।
বিশেষভাবে দু প্রকারের ইবাদত রামাদানে বেশি করে পালন করতে হাদীসে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, দান। “সাদকা” বা দান আল্লাহ তাআলার প্রিয়তম ইবাদত। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন যে, সাদকার কারণে মুমিন অগণিত সাওয়াব লাভ ছাড়াও অতিরিক্ত দুটি পুরস্কার লাভ করেন: প্রথমত দানের কারণে গোনাহ ক্ষমা করা হয় এবং দ্বিতীয়ত দানের কারণে আল্লাহর বালা-মুসিবত দূর হয়। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন যে, দুজন মানুষের মধ্যে বিবাদ মিটিয়ে দেওয়া, ন্যায় কর্মে নির্দেশ দেওয়া, অন্যায় থেকে নিষেধ করা, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক দ্রব্য বা বস্তু সরিয়ে দেওয়া, বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করা বা যে কোনোভাবে মানুষের উপকার করাই আল্লহর নিকট সাদকা হিসাবে গণ্য। রাসূলুল্লাহ সা. সর্বদা বেশি বেশি দান করতে ভালবাসতেন। আর রামাদান মাসে তাঁর দান হতো সীমাহীন। কোনো যাচ্ঞাকারীকে বা প্রার্থীকে তিনি বিমুখ করতেন না।
রামাদান আসলেই দ্রব্যমূল বেড়ে যায়। বাংলাদেশ মুসলমানদের দেশ। এদেশের অধিকাংশ ব্যবসায়ী মুসলাম। অধিকাংশ ব্যবসায়ী রোযা রাখেন এবং দান করেন। কিন্তু আমাদের দান হালাল উপার্জন থেকে হচ্ছে কিনা তা দেখতে হবে। গুদামজাত করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা বা স্বাভাবিকের বাইরে অতিরিক্ত দাম গ্রহণের মাধ্যমে ক্রেতাদের জুলুম করা নিষিদ্ধ। হারাম বা নিষিদ্ধভাবে লক্ষ টাকা আয় করে তার থেকে হাজার টাকা ব্যয় করার চেয়ে হালাল পদ্ধতিতে হাজার টাকা আয় করে তা থেকে দু-এক টাকা ব্যয় করা অনেক বেশি সাওয়াব ও বরকতের কাজ। এ ছাড়া অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয আমাদের মনে রাখতে হবে। আমরা জানি, মানুষের কল্যাণে ও সহমর্মিতায় যা কিছু করা হোক সবই দান। যদি কোনো সৎ ব্যবসায়ী যদি রামাদানে ক্রেতা সাধারণের সুবিধার্থে তার প্রতিটি পন্যে এক টাকা কম রাখেন বা নায্যমূল্যে তা বিক্রয় করেন তাও আল্লাহর নিকট অত্যন্ত বড় সাদকা হিসেবে গণ্য হবে।
রামাদানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো কুরআন তিলওয়াত। বিগত খুতবায় আমরা এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করেছি। রামাদানে দু ভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে: প্রথমত কুরআন কারীম দেখে দেখে দিবসে ও রাতে তিলাওয়াত করতে হবে। সাহাবী-তাবিয়ীগণ রামাদানে এভাবে তিলাওয়াত করে কেউ তিন দিনে, কেউ ৭ দিনে বা কেউ ১০ দিনে কুরআন খতম করতেন। আমাদের সকলকেই চেষ্টা করতে হবে রামাদানে কয়েক খতম কুরআন তিলাওয়াতেরর। তিলাওয়াতের সাথে তা বুঝার জন্য অর্থ পাঠ করতে হবে। কুরআনের অর্থ বুঝা, চিন্তা করা ও আলোচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যার জন্য অতিরিক্ত সাওয়াব, বরকত ও ঈমান বৃদ্ধির কথা কুরআন ও হাদীসে বলা হয়েছে। সম্ভব হলে অর্থসহ অন্তত একখতম কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে। যারা তিলাওয়াত করতে পারেন না তারা আল্লাহর ওয়াস্তে রামাদানে তিলাওয়াত শিখতে শুরু করুন। অবসর সময়ে তিলাওয়াতের বা অর্থসহ তিলাওয়াতের ক্যাসেটে শুনুন। কুরআন তিলাওয়াতে যেমন সাওয়াব, তা শ্রবণেও তেমনি সাওয়াব।
পরবর্তী প্রবন্ধে আমরা আহকামে কিয়াম বা রাত্রের বিশেষ নামাযের ফজিলত ও বিধান নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
السَّحُورُ أَكْلُهُ بَرَكَةٌ فَلا تَدَعُوهُ وَلَوْ أَنْ يَجْرَعَ أَحَدُكُمْ جُرْعَةً مِنْ مَاءٍ فَإِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ وَمَلائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى الْمُتَسَحِّرِينَ
“সাহরী খাওয়া বরকত; কাজেই তোমরা তা ছাড়বে না; যদি এক ঢোক পানি পান করেও হয় তবুও; কারণ যারা সাহরী খায় তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাগণ সালাত (রহমত ও দুআ) প্রদান করেন।” আহমদ, আল-মুসনাদ ৩/১২, ৪৪; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ৮/২৪৫; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২৫৮। হাদীসটি হাসান।
কোনো কোনো হাদীসে সাহরীতে খেজুর খেতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সাহরী খাওয়ার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সা.-এর সুন্নাত ও শিক্ষা হলো একেবারে শেষ মুহূর্তে সাহরী খাওয়া। যাইদ ইবনু সাবিত বলেন:
تَسَحَّرْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ ثُمَّ قُمْنَا إِلَى الصَّلاةِ قُلْتُ كَمْ كَانَ قَدْرُ مَا بَيْنَهُمَا قَالَ خَمْسِينَ آيَةً
“আমরা রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে সাহরী খেলাম এরপর ফজরের সালাতে দাঁড়ালাম। যাইদকে জিজ্ঞাসা করা হলো, মাঝে কতটুকু সময় ছিল? তিনি বলেন ৫০ আয়াত তিলাওয়াতের মত।” বুখারী আস-সহীহ ২/৬৭৮; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭৭১।
রাসূলুল্লাহ সা.-এর সুন্নাত সুর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা। তিনি এত তাড়াতাড়ি ইফতার করতেন যে, অনেক সময় সাহাবীগণ বলতেন, হে আল্লাহর রাসূল, সন্ধ্যা হোক না, এখনো তো দিন শেষ হলো না! তিনি বলতেন, সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই ইফতার করতে হবে। বিভিন্ন হাদীসে রয়েছে যে, সাহাবীগণ সর্বদা শেষ সময়ে সাহরী খেতেন এবং সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করতেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
لا يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ
“যতদিন মানুষ সুর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে তাড়াতাড়ি ইফতার করবে ততদিন তারা কল্যাণে থাকবে।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৬৯২; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭৭১।
إِنَّا مَعْشَرَ الأَنْبِيَاءِ أُمِرْنَا بِتَعْجِيْلِ فِطْرِنَا وَتَأْخِيْرِ سُحُوْرِنَا
“আমরা নবীগণ আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রথম সময়ে ইফতার করতে ও শেষ সময়ে সাহরী খেতে।” হাইসামী, মাজামউয যাওয়াইদ২/১০৫, ৩/১৫৫। হাদীসটির সনদ সহীহ।
ইফতারের জন্য রাসূলুল্লাহ সা.-এর নির্দেশ হলো খেজুর মুখে দিয়ে ইফতার করা। তিনি সম্ভব হলে গাছ পাকা টাটকা রুতাব খেজুর, না হলে খুরমা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। খেজুর না পেলে তিনি পানি মুখে দিয়ে ইফতার করতেন। তিনি ইফতারিতে তিনটি খেজুর খেতে পছন্দ করতেন। যিয়া মাকদিসী, আল-মুখতারাহ ৫/১৩১-১৩২; হাইসামী, মাজমাউয ৩/১৫৫-১৫৬। এ বিষয়ে অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
সাহরীর সময় রোযাদারদের ডাকা মুসলিম উম্মাহর একটি বরকতময় রীতি। বর্তমানে প্রত্যেক মসজিদে মাইক থাকার কারণে বাড়ি বাড়ি বা মহল্লার মধ্যে যেয়ে ডাকার রীতি উঠে গিয়েছে। মসজিদের মাইক থেকেই ডাকা হয়। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, ডাকার উদ্দেশ্য যারা সাহরী খেতে চান তাদেরকে ঘুম ভাঙ্গতে সাহায্য করা। এজন্য ফজরের আযানের ঘন্টাখানেক আগে কিছু সময় ডাকাডাকি করাই যথেষ্ট। বর্তমানে অনেক মসজিদে শেষ রাতে একদেড় ঘন্টা একটানা গজল-কিরাআত পড়া হয় ও ডাকাডাকি করা হয়। বিষয়টি খুবই নিন্দনীয় ও আপত্তিকর কাজ। অনেকেই সাহরীর এ সময়ে খাওয়ার আগে বা পরে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করেন, বা তিলাওয়াত করেন, কেউ বা সাহরী খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন, কারণ সকালে তার কাজ আছে, অনেক অসুস্থ মানুষ থাকেন। এরা সকলেই এরূপ একটানা আওয়াজে ক্ষতিগ্রস্থ হন। বান্দার হক্কের দিকে আমাদের বিশেষ লক্ষ্য রাখা দরকার।
সাহরী ও ইফতার খাওয়ার অর্থ এ নয় যে, সারাদিন যেহেতু খাব না, সেহেতু এ দু সময়ে দ্বিগুণ খেয়ে সারাদিন জাবর কাটব! এরূপ খেলে তো সিয়ামের মূল উদ্দেশ্যই নষ্ট হলো। সাহরী ও ইফতার খাওয়ার অর্থ স্বাভাবিকভাবে আমরা যা খাই তা খাওয়া। সমাজে প্রচলিত আছে যে, সাহরী ও ইফতারীতে বা রামাদানে যা খাওয়া হবে তার হিসাব হবে না। এজন্য আমরা রামাদান মাসকে খাওয়ার মাস বানিয়ে ফেলেছি। বস্তুত, হিসাব হবে কি না তা চিন্তা না করে, সাওয়াব কিসে বেশি হবে তা চিন্তা করা দরকার। রামাদান মাস মূলত খাওয়ানোর মাস। দুভাবে খাওয়ানোর নির্দেশ রয়েছে হাদীসে। প্রথমত দরিদ্রদেরকে খাওয়ানো এবং দ্বিতীয়ত রোযাদারকে ইফতার খাওয়ানো। রোযা অবস্থায় দরিদ্রকে খাওয়ানোর ফযীলত আমরা অন্য খুতবায় জেনেছি। আর ইফতার করানোর বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ غَيْرَ أَنَّهُ لا يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الصَّائِمِ شَيْئًا
“যদি কেউ কোনো রোযাদারকে ইফতার করায়, তাহলে সে উক্ত রোযাদারের সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে, তবে এতে উক্ত রোযাদারের সাওয়াব একটুও কমবে না।” তিরমিযী, আস-সুনান ৩/১৭১। তিরমিযী বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ।
ইফতার করানো অর্থ আনুষ্ঠানিকতা নয়। দরিদ্র সাহাবী-তাবিয়ীগণ নিজের ইফতার প্রতিবেশীকে দিতেন এবং প্রতিবেশীর ইফতার নিজে নিতেন। এতে প্রত্যেকেই ইফতার করানোর সাওয়াব পেলেন। অনেকে নিজের সামান্য ইফতারে একজন মেহমান নিয়ে বসতেন। আমাদের সকলেরই চেষ্টা করা দরকার নিয়মিত নিজেদের খাওয়া থেকে সামান্য কমিয়ে অন্যদেরকে ইফতার করানো। বিশেষত দরিদ্র, কর্মজীবি, রিকশাওয়ালা অনেকেই কষ্ট করে রোযা রাখেন এবং ইফতার করতেও কষ্ট হয়। সাধ্যমত নিজেদের খাওয়া একটু কমিয়ে এদেরকে খাওয়ানো দরকার।
হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, রামাদান মাসে যারা সিয়াম পালন করেন তাদের দুটি শ্রেণী রয়েছে। এক শ্রেণীর পূর্ববর্তী সকল গোন্হা ক্ষমা করা হবে। অন্য শ্রেণী ক্ষুধা-পিপাসায় কষ্ট করা ছাড়া কিছুই লাভ হবে না। প্রথম শ্রেণীর রোযাদারদের বিষযে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
“যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং আল্লাহর নিকট সাওয়াব অর্জনের খাঁটি নিয়্যাতে রামাদানের সিয়াম পালন করবে তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে।” বুখারী, আস-সহীহ ১/২২, ২/৬৭২, ৭০৯; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৫২৩।
দ্বিতীয় শ্রেণীর রোযাদারদের বিষয়ে তিনি বলেন:
رُبَّ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهِ إِلاَّ الْجُوعُ وَرُبَّ قَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ قِيَامِهِ إِلاَّ السَّهَرُ
“অনেক সিয়াম পালনকারী আছে যার সিয়াম থেকে শুধু ক্ষুধা ও পিপাসা ছাড়া আর কোন লাভ হয় না। এবং অনেক কিয়ামকারী বা তারাবীহ-তাহাজ্জুদ পালনকারী আছে যাদের কিয়াম-তারাবীহ থেকে শুধু রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কোনোই লাভ হয় না।” ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৫৩৯; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২৬২। হাদীসটি সহীহ।
এরূপ রোযাদারদের প্রতি বদদোয়া করে তাদের দুর্ভাগ্যের কথা জানিয়ে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
بَعُدَ مَنْ أَدْرَكَ رَمَضَانَ فَلَمْ يُغْفَرْ لَهُ
“যে ব্যক্তি রামাদান মাস পেল, কিন্তু এই মাসে তাকে ক্ষমা করা হলো না সেই ব্যক্তি আল্লাহর রহমত থেকে চির-বঞ্চিত বিতাড়িত।” হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/১৭০; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ২/১৪০-১৪১; আলবানী সহীহুত তারগীব ১/২৬২। হাদীসটি সহীহ।
আমরা যারা রামাদানের সিয়াম পালন করতে যাচ্ছি তাদের একটু ভাবতে হবে, আমরা কোন্ দলে পড়ব। আর তা জানতে হলে রোযা বা সিয়ামের অর্থ বুঝতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
لَيْسَ الصِّيَامُ مِنَ الأَكْلِ وَالشُّرْبِ إِنَّمَا الصِّيَامُ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ
“পানাহার বর্জনের নাম সিয়াম নয়। সিয়াম হলো অনর্থক ও অশ্লীল কথা-কাজ বর্জন করা।” ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ৮/২৫৫; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৫৯৫; আলবানী, সহীহহুত তারগীব ১/২৬১। হাদীসটি সহীহ।
তাহলে চিন্তাহীন, অনুধাবনহীন, সৎকর্মহীন পানাহার বর্জন “উপবাস” বলে গণ্য হতে পারে তবে ইসলামী “সিয়াম” বলে গণ্য হবে না। হারাম বা মাকরূহ কাজেকর্মে রত থেকে হালাল খাদ্য ও পানীয় থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখার নাম সিয়াম নয়। সিয়াম অর্থ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সকল হারাম, মাকরূহ ও পাপ বর্জন করার সাথে সাথে হালাল খাদ্য, পানীয় ও সম্ভোগ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। এভাবে হৃদয়ে সার্বক্ষণিক আল্লাহ সচেতনতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে লক্ষ্য রেখে শত প্রলোভন ও আবেগ দমন করে সততা ও নিষ্ঠার পথে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য সিয়াম। যদি আপনি কঠিন ক্ষুধা বা পিপাসায় কাতর হয়েও আল্লাহর ভয়ে ও তাঁর সন্তুষ্টির আশায় নিজেকে খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত রাখেন, অথচ সামান্য রাগের জন্য গালি, ঝগড়া ইত্যাদি হারাম কাজে লিপ্ত হন, মিথ্যা অহংবোধকে সমুন্নত করতে পরনিন্দা, গীবত, চোগলখুরী ইত্যাদি ভয়ঙ্কর হারামে লিপ্ত হন, সামান্য লোভের জন্য মিথ্যা, ফাঁকি, সুদ, ঘুষ ও অন্যান্য যাবতীয় হারাম নির্বিচারে ভক্ষণ করেন, তাহলে আপনি নিশ্চিত জানুন যে, আপনি সিয়ামের নামে আত্মপ্রবঞ্চনার মধ্যে লিপ্ত আছেন। ধার্মিকতা ও ধর্ম পালনের মিথ্যা অনুভতি ছাড়া আপনার কিছুই লাভ হচ্ছে না। রাসলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ وَالْجَهْلَ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ
“যে ব্যক্তি পাপ, মিথ্যা বা অন্যায় কথা, অন্যায় কর্ম, ক্রোধ, মূর্খতাসুলভ ও অজ্ঞতামুলক কর্ম ত্যাগ করতে না পারবে, তার পানাহার ত্যাগ করাতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৬৭৩, ৫/২২৫১।
আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, তোমরা রোযার সময় দিবসে পানাহার করো না। এর পরের আয়াতেই আল্লাহ বললেন, তোমরা অপরের সম্পদ অবৈধভাবে “আহার” করো না। এখন আপনি প্রথম আয়াতটি মেনে দিবসে আপনার ঘরের খাবার আহার করলেন না, কিন্তু পরের আয়াতটি মানলেন না, সুদ, ঘুষ, জুলুম, চাঁদাবাজি, যৌতুক, মিথ্যা মামলা, যবর দখল, সরকারি সম্পত্তি অবৈধ দখল ইত্যাদি নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে অন্যের সম্পদ “আহার” করলেন, তাহলে আপনি কেমন রোযাদার?
একটি বিশেষ “আহার” হলো “গীবত”। “গীবত” শতভাগ সত্য কথা। যেমন লোকটি বদরাগী, লোভী, ঘুমকাতুরে, ঠিকমত জামাতে নামায পড়ে না, অমুক দোষ করে, কথার মধ্যে অমুক মুদ্রা দোষ আছে ইত্যাদি। এরূপ দোষগুলি যদি সত্যই তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে তবে তার অনুপস্থিতিতে তা অন্য কাউকে বলা বা আলোচনা করা “গীবত”। আল্লাহ বলেছেন, গীবত করা হলো মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়া। মৃতভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করার মতই “গীবত” করা সর্ববস্থায় হারাম। উপরন্তু সিয়ামরত অবস্থায় গীবত করলে “মাংস খাওয়ার” কারণে সিয়াম নষ্ট হবে বা সিয়ামের সাওয়াব সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে।
সিয়াম শুধু বর্জনের নাম নয়। সকল হারাম ও মাকরূহ বর্জনের সাথে সাথে সকল ফরয-ওয়াজিব ও যথাসম্ভব বেশি নফল মুস্তাহাব কর্ম করাই সিয়াম। বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায় যে, রামাদান মাসে নফল-ফরয সকল ইবাদতের সাওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এজন্য সকল প্রকার ইবাদতই বেশি বেশি আদায় করা দরকার। সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রামাদান মাসে উমরা আদায় করা রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে হজ্জ করার সমতুল্য। যদি কেউ রোযা অবস্থায় দরিদ্রকে খাবার দেয়, অসুস্থ মানুষকে দেখতে যায় এবং জানাযায় শরীক হয় তবে সে ব্যক্তিকে আল্লাহ জান্নাত দান করবেন। এ ছাড়া হাদীসে রামাদানে বেশি বেশি তাসবীহ, তাহলীল, দুআ ও ইসতিগফারের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন যে, রোযা অবস্থার দুআ ও ইফতারের সময়ের দুআ আল্লাহ কবুল করেন।
বিশেষভাবে দু প্রকারের ইবাদত রামাদানে বেশি করে পালন করতে হাদীসে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, দান। “সাদকা” বা দান আল্লাহ তাআলার প্রিয়তম ইবাদত। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন যে, সাদকার কারণে মুমিন অগণিত সাওয়াব লাভ ছাড়াও অতিরিক্ত দুটি পুরস্কার লাভ করেন: প্রথমত দানের কারণে গোনাহ ক্ষমা করা হয় এবং দ্বিতীয়ত দানের কারণে আল্লাহর বালা-মুসিবত দূর হয়। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন যে, দুজন মানুষের মধ্যে বিবাদ মিটিয়ে দেওয়া, ন্যায় কর্মে নির্দেশ দেওয়া, অন্যায় থেকে নিষেধ করা, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক দ্রব্য বা বস্তু সরিয়ে দেওয়া, বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করা বা যে কোনোভাবে মানুষের উপকার করাই আল্লহর নিকট সাদকা হিসাবে গণ্য। রাসূলুল্লাহ সা. সর্বদা বেশি বেশি দান করতে ভালবাসতেন। আর রামাদান মাসে তাঁর দান হতো সীমাহীন। কোনো যাচ্ঞাকারীকে বা প্রার্থীকে তিনি বিমুখ করতেন না।
রামাদান আসলেই দ্রব্যমূল বেড়ে যায়। বাংলাদেশ মুসলমানদের দেশ। এদেশের অধিকাংশ ব্যবসায়ী মুসলাম। অধিকাংশ ব্যবসায়ী রোযা রাখেন এবং দান করেন। কিন্তু আমাদের দান হালাল উপার্জন থেকে হচ্ছে কিনা তা দেখতে হবে। গুদামজাত করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা বা স্বাভাবিকের বাইরে অতিরিক্ত দাম গ্রহণের মাধ্যমে ক্রেতাদের জুলুম করা নিষিদ্ধ। হারাম বা নিষিদ্ধভাবে লক্ষ টাকা আয় করে তার থেকে হাজার টাকা ব্যয় করার চেয়ে হালাল পদ্ধতিতে হাজার টাকা আয় করে তা থেকে দু-এক টাকা ব্যয় করা অনেক বেশি সাওয়াব ও বরকতের কাজ। এ ছাড়া অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয আমাদের মনে রাখতে হবে। আমরা জানি, মানুষের কল্যাণে ও সহমর্মিতায় যা কিছু করা হোক সবই দান। যদি কোনো সৎ ব্যবসায়ী যদি রামাদানে ক্রেতা সাধারণের সুবিধার্থে তার প্রতিটি পন্যে এক টাকা কম রাখেন বা নায্যমূল্যে তা বিক্রয় করেন তাও আল্লাহর নিকট অত্যন্ত বড় সাদকা হিসেবে গণ্য হবে।
রামাদানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো কুরআন তিলওয়াত। বিগত খুতবায় আমরা এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করেছি। রামাদানে দু ভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে: প্রথমত কুরআন কারীম দেখে দেখে দিবসে ও রাতে তিলাওয়াত করতে হবে। সাহাবী-তাবিয়ীগণ রামাদানে এভাবে তিলাওয়াত করে কেউ তিন দিনে, কেউ ৭ দিনে বা কেউ ১০ দিনে কুরআন খতম করতেন। আমাদের সকলকেই চেষ্টা করতে হবে রামাদানে কয়েক খতম কুরআন তিলাওয়াতেরর। তিলাওয়াতের সাথে তা বুঝার জন্য অর্থ পাঠ করতে হবে। কুরআনের অর্থ বুঝা, চিন্তা করা ও আলোচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যার জন্য অতিরিক্ত সাওয়াব, বরকত ও ঈমান বৃদ্ধির কথা কুরআন ও হাদীসে বলা হয়েছে। সম্ভব হলে অর্থসহ অন্তত একখতম কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে। যারা তিলাওয়াত করতে পারেন না তারা আল্লাহর ওয়াস্তে রামাদানে তিলাওয়াত শিখতে শুরু করুন। অবসর সময়ে তিলাওয়াতের বা অর্থসহ তিলাওয়াতের ক্যাসেটে শুনুন। কুরআন তিলাওয়াতে যেমন সাওয়াব, তা শ্রবণেও তেমনি সাওয়াব।
পরবর্তী প্রবন্ধে আমরা আহকামে কিয়াম বা রাত্রের বিশেষ নামাযের ফজিলত ও বিধান নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
No comments