Header Ads

সিয়াম, রামাদান ও কুরআন

সিয়াম ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এই প্রবন্ধে আমরা সিয়াম ও রামাদান সম্পর্কে আলোচনা করব, ইনশা আল­াহ।
প্রভাত (সুবহে সাদেক) থেকে সূর্যাস্ত (মাগরিব) পর্যন্ত আল্লাহরা এবাদত ও সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পানাহার, দাম্পত্য মিলন ইত্যাদি সকল সিয়াম বা রোযা ভঙ্গকারী কর্ম থেকে বিরত থাকা হল সিয়াম বা রোযা। আত্মার পরিশুদ্ধি, আধ্যাত্মিক উন্নতি, মানবিক মমতাবোধের বিকাশ, তাকওয়া ও সততা অর্জনের জন্য সকল যুগের সকল বিশ্বাসী মানুষের অন্যতম প্রধান অবলম্বন হলো সিয়াম। রমযানের সিয়াম ফরয ও ইসলামের রুকন। এছাড়া যথাসম্ভব বেশি অতিরিক্ত বা নফল সিয়াম পালনে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ফরয ও নফল সিয়ামের ফযীলতে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, আল­াহ বলেন:
كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلاَّ الصِّيَامَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلا يَرْفُثْ وَلا يَصْخَبْ فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ يَفْرَحُهُمَا إِذَا أَفْطَرَ فَرِحَ وَإِذَا لَقِيَ رَبَّهُ فَرِحَ بِصَوْمِهِ
“আদম সন্তানের সকল কর্ম তার জন্য। একমাত্র ব্যতিক্রম হলো সিয়াম, তা শুধু আমারই জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দিব। সিয়াম হলো ঢাল। তোমাদের কেউ যে দিনে সিয়াম পালন করবে সেই দিনে সে অশ্লীল বা বাজে কথা বলবে না ও চিল্লাচিলি­, হৈচৈ বা ঝগড়াঝাটি করবে না। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে মারামারি করে তবে সে যেন বলে, আমি সিয়ামরত, আমি সিয়াম রত। মুহাম্মাদের জীবন যাঁর হাতে তার শপথ, সিয়ামরত ব্যক্তির মুখের ক্ষুধা-জনিত গন্ধ আল­াহর নিকট মেশকের সুগন্ধির চেয়েও প্রিয়। সিয়াম পালনকারীর জন্য দুইটি আনন্দ রয়েছে যখন সে আনন্দিত হয়: (১) যখন সে ইফতার করে তখন সে তার ইফতারীর জন্য আনন্দিত হয় এবং (২) যখন সে তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাত করবে তখন সে তার সিয়ামের জন্য আনন্দিত হবে।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৬৭৮; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮০৭।
তিনি আরো বলেন:
اَلصِّيَامُ جُنَّةٌ مِنَ النَّارِ كَجُنَّةِ أَحَدِكُمْ مِنَ الْقِتَالِ وَصيَامٌ حَسَنٌ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ
“যুদ্ধে তোমাদের যেমন ঢাল থাকে, তেমনি জাহান্নামের আগুন থেকে ঢাল হলো সিয়াম। আর প্রতি মাসে তিন দিন সিয়াম পালন করা ভাল।” ইবনু খুযাইমা, আস-সহীহ ৩/১৯৩; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২৩৮। হাদীসটি সহীহ।
প্রতি মাসে তিন দিন সিয়াম ছাড়াও যথাসম্ভব বেশি বেশি নফল সিয়াম পালনে উৎসাহ দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সা.); কারণ সিয়াম একটি তুলনাবিহীন ইবাদত। আবূ উমামা (রা) বলেন, “আমি বললাম, হে আল­াহর রাসূল, আমাকে একটি আমল শিখিয়ে দিন। তিনি বলেন,
عَلَيْكَ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لا عَدْلَ لَهُ
“তুমি সিয়াম পালন করবে, সিয়ামের মত আমল আর নেই।”আবূ উমামা বলেন, আমি তিনবার তাঁকে একইরূপ অনুরোধ করলাম এবং তিনি তিনবারই একই উত্তর দিলেন।” এজন্য আবূ উমার প্রায় ১২ মাসই সিয়াম পালন করতেন।” নাসাঈ ৪/১৬৫; ইবনু খুযাইমা, আস-সহীহ ৩/১৯৪; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৫৮২; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২৩৮। হাদীসটি সহীহ।
নফল সিয়াম পালনের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো আশুরার দিন, আরাফাতের দিন এবং শাওয়াল মাসের ৬ দিন। এছাড়া প্রতি সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার এবং প্রতি আরবী মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ নফল সিয়াম পালন বিশেষ গুরত্বপূর্ণ ইবাদত। হাযেরীন, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, মাসে কয়েক দিন সিয়াম পালন করা দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
রামাদান মাসের ফরয সিয়াম পালন ইসলামের চতুর্থ স্তম্ভ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
إِذَا جَاءَ رَمَضَانُ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ وَصُفِّدَتْ الشَّيَاطِينُ
“রামাদান মাস যখন আগমন করে তখন জান্নাতের দরজাগুলি খুলে দেওয়া হয়, এবং জাহান্নামের দরজাগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়, এবং শয়তানগেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৬৭২, ৩/১১৯৪; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭৫৮।
أَتَاكُمْ رَمَضَانُ شَهْرٌ مُبَارَكٌ فَرَضَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ تُفْتَحُ فِيهِ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَتُغْلَقُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَحِيمِ وَتُغَلُّ فِيهِ مَرَدَةُ الشَّيَاطِينِ لِلَّهِ فِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ مَنْ حُرِمَ خَيْرَهَا فَقَدْ حُرِمَ
“তোমাদের নিকট রামাদান মাস এসেছে। এই মাসটি বরকতময়। আল­াহ তোমাদের উপর এই মাসের সিয়াম ফরয করেছেন। এই মাসে আসমানের দরজাগুলি খুলে দেওয়া হয়। এবং এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই মাসে দুর্বিনীত শয়তানদেরকে শৃঙ্খলিত করা হয়। এই মাসে এমন একটি রাত আছে যা এক হাজার রাত অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি সেই রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত সে একেবারেই বঞ্চিত হতভাগা।” নাসাঈ, আস-সুনান ৪/১২৯; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২৪১। হাদীসটি সহীহ।
সিয়াম ফরয করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহান আল­াহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
“হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর সিয়াম লিপিবদ্ধ (ফরয) করা হয়েছে, যেরূপভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।” সূরা বাকারা: ১৮৩ আয়াত।
আমরা দেখেছি, আল­াহ বলেছেন যে, সিয়ামের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন হবে। তাকওয়া অর্থ হলো হৃদয়ের মধ্যে আল­াহর অসন্তুষ্টি ও শাস্তিথেকে আত্মরক্ষার সার্বক্ষণিক অনুভূতি। যে কোনো কথা, কর্ম বা চিন্তার আগেই মনে হবে, এতে আল­াহ খুশি না বেজার হবেন। যদি আল­াহর অসন্তুষ্টির বিষয় হয় তবে কোনো অবস্থাতেই হৃদয় সে কাজ করতে দেবে না।
আমরা একথা স্বীকার করতে বাধ্য হব যে, পরিপূর্ণ তাকওয়া আমরা সিয়ামের মাধ্যমে অর্জন করতে পারছি না। একজন রোযাদার প্রচণ্ড ক্ষুধা বা পিপাসায় কাতর হয়েও কোনো অবস্থাতে পানাহার করতে রাজি হন না। নিজের ঘরের মধ্যে, একাকী, নির্জনে সকল মানুষের অজান্তে পিপাসা মেটানোর সুযোগ থাকলেও তিনি তা করেন না। কারণ তিনি জানেন তা করলে দুনিয়ার কেউ না জানলেও আল­াহ জানবেন ও তিনি অসন্তুষ্ট হবেন। এ হলো তাকওয়ার প্রকাশ। কিন্তু এ ব্যক্তিই রোযা অবস্থায় বা অন্য সময়ে এর চেয়ে অনেক কম পিপাসায় বা প্রলোভনে সুদ, ঘুষ, মিথ্যা, গীবত, ভেজাল, ওযনে ফাঁকি, কর্মে ফাঁকি, অন্যের পাওনা না দেওয়া ও অন্যান্য কঠিনতম পাপের মধ্যে নিমজ্জিত হচ্ছেন। কেন এরূপ হচ্ছে? এর অন্যতম কারণ হলো আমরা প্রেসক্রিপশন পাল্টে ফেলেছি। কোনো রোগে যদি ডাক্তার দুটি বা তিনটি ঔষধ দেন, আর রোগী একটি ঔষধ খেয়ে সুস্থ হতে চান তাহলে তিনি প্রকৃত সুস্থতা লাভ করতে পারবেন না। মহান আল­াহ তাকওয়া অর্জনের জন্য আমাদেরকে দুটি বিষয় একত্রে দিয়েছেন: সিয়াম ও কুরআন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা সিয়াম নিয়েছি এবং কুরআন বাদ দিয়েছি। এজন্য প্রকৃত ও পরিপূর্ণ তাকওয়া অর্জন করতে পারছি না। আল­াহ বলেছেন:
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ
“রামাদান মাস। এতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে তারা যেন এই মাসে সিয়াম পালন করে।” সূরা বাকারা: ১৮৫ আয়াত।
এভাবে আমরা দেখছি যে, মহান আল­াহ কুরআনের সাথে রামাদানের সিয়ামকে জড়িত করেছেন। হাদীস থেকে জানা যায় যে, দুভাবে এ সংশ্লিষ্টতা। প্রথমত রামাদানে রাতদিন কুরআন তিলাওয়াত করা এবং দ্বিতীয়ত রাতে কিয়ামুল­াইল বা তারাবীহের সালাতে কুরআন পড়া বা শুনা।
মুমিনের অন্যতম ইবাদত কুরআন তিলাওয়াত করা। আল­াহর সর্বশ্রেষ্ঠ যিক্র কুরআন তিলাওয়াত। কুরআন কারীমের একটি আয়াত শিক্ষা করা ১০০ রাক‘আত নফল সালাতের চেয়েও উত্তম বলে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে। সারা বৎসরই তিলাওয়াত করতে হবে। বিশেষত রামাদানে বেশি তিলাওয়াত করা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিশেষ সুন্নাত, যাতে অতিরিক্ত সাওয়াব ও বরকত রয়েছে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আমাদের মধ্যে উপস্থিত অনেক মুসল­ীই কুরআন পড়তে পারেন না। যদি দুনিয়ার কোনো মন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি আপনাকে একটি চিঠি পাঠান তা পড়তে ও বুঝতে আপনি কত ব্যস্ত হন। আর রাব্বুল আলামীন আল­াহ তাঁর হাবীব মুহাম্মাদ (সা)-এর মাধ্যমে আপনাকে এ কিতাবটি পাঠালেন, আর আপনি একটু পড়ে দেখলেন না। হাযেরীন, আল­াহর কাছে যেয়ে কি জবাব দিবেন। যে কিতাব পাঠ করে এখনো হাজার হাজার কাফির মুসলিম হচ্ছে, আপনি মুসলিম হয়ে সে কিতাবটা পড়লেন না। অনেক নও-মুসলিম আছেন যারা মুসলিম হওয়ার পরে ৩/৪ বৎসরের ভিতরে কুরআন তিলাওয়াত ও অর্থ বুঝার যোগ্যতা অর্জন করেন। আর আমরা জন্ম থেকে মুসলমান আমরা অনেকেই কুবআন পড়তে পারি না। আমরা সংবাদ শুনে, পড়ে, সংবাদ পর্যালোচনা করে, অকারণ গীবত করে, বাজে গালগল্প করে কত সময় নষ্ট করি। অথচ আল­াহর কিতাব তিলাওয়াত শেখার সময় হয় না। হাযেরীন, কুরআন তিলাওয়াত শিখতে বেশি সময় লাগে না। নূরানী পদ্ধতি, নাদিয়া পদ্ধতি বিভিন্ন আধুনকি পদ্ধতিতে মাত্র ৩/৪ মাস পড়লেই বিশুদ্ধভাবে তিলাওয়াত শেখা যায়। আসুন আমরা কুরআনের মাস রামাদান উপলক্ষ্যে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা করি। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ
“তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি কুরআন শিক্ষা করে ও শিক্ষা দান করে সেই সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।” সহীহ বুখারী ৪/১৯১৯।
مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا
“যে ব্যক্তি কুরআনের একটি বর্ণ পাঠ করবে সে একটি পুণ্য বা নেকী অর্জন করবে। পুণ্য বা নেকীকে দশগুণ বৃদ্ধি করে প্রদান করা হবে।তিরমিযী ৫/১৭৫, নং ২৯১০। হাদীসটি সহীহ।
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
الْمَاهِرُ بِالْقُرْآنِ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ وَالَّذِي يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَيَتَتَعْتَعُ فِيهِ وَهُوَ عَلَيْهِ شَاقٌّ لَهُ أَجْرَانِ
“যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াতে সুপারদর্শী সে সম্মানিত ফিরিশতাগণের সঙ্গে। আর কুরআন তিলাওয়াত করতে যার জিহ্বা জড়িয়ে যায়, উচ্চারণে কষ্ট হয়, কিন্তু কষ্ট করে অপারগতা সত্তে¡ও সে তিলাওয়াত করে তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ পুরস্কার।” সহীহ বুখারী ৬/২৭৪৩, সহীহ মুসলিম ১/৫৪৯।
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.)  বলেন:
اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لأَصْحَابِهِ
“তোমরা কুরআন পাঠ করবে; কারণ কুরআন কিয়ামতের দিন তার সঙ্গীদের (কুরআন পাঠকারীগণের) জন্য শাফা’আত করবে।” সহীহ মুসলিম ১/৫৫৩।
কুরআন সাধারণভাবে দিবারাত্র সকল সময়ে পাঠ করা যায়। আর মুমিনের কুরআন পাঠের বিশেষ সময় হলো রাত্রে কিয়ামুল­াইল বা তাহাজ্জুদের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াত করা। কুরআন কারীমে এরূপ তিলাওয়াতকে মুমিনের বিশেষ বৈষিষ্ট্য হিসেবে উলে­খ করা হয়েছে। রামাদানের রাত্রিতে সালাতুল­াইল আদায় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। কিয়ামুল­াইল বা তারাবীহে এক বা একাধিকবার পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত বা শ্রবণ করাও গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। এরূপ রাতের তিলাওয়াতের কথাই রাসূলুল্লাহ (সা.)  বলেছেন:
اَلصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَقُوْلُ الصِّيَامُ رَبِّ إِنِّيْ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّرَابَ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِيْ فِيْهِ وَيَقُوْلُ الْقُرْآنُ رَبِّ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِيْ فِيْهِ فَيُشَفَّعَانِ.
“রোযা ও কুরআন বান্দার জন্য শাফা’আত করবে। রোযা বলবে : হে রব্ব, আমি একে দিনের বেলায় খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত রেখেছি, কাজেই তার পক্ষে আমার শাফা’আত কবুল করুন। কুরআন বলবে : হে রব্ব, আমি রাতের বেলায় তাকে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, কাজেই তার পক্ষে আমার শাফা’আত কবুল করুন। তখন তাদের উভয়ের শাফা’আত কবুল করা হবে।” মুসতাদরাক হাকিম ১/৭৪০, মুসনাদ আহমদ ২/১৭৪, আত-তারগীব ২/১০, ৩২৫, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৩৮১। হাদীসটি সহীহ।
কুরআন কারীম তিলাওয়াতের ন্যায় তা শোনাও একইরূপ সাওয়াব। এজন্য তারাবীহের সালাতে পরিপূর্ণ আদবের সাথে মনোযোগ দিয়ে কুরআন শুনতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবহেলা খুবই বেশি। রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সুন্নাত হলো ধীরে ধীরে ও টেনে টেনে তিলাওয়াত করা এবং প্রত্যেক আয়াতের শেষে থামা। এভাবে তিলাওয়াত করলেই তিলাওয়াতের সাওয়াব পাওয়া যাবে এবং এরূপ তিলাওয়াত শুনলেও তিলাওয়াতের মতই সাওয়াব পাওয়া যাবে। তাড়াহুড়ো করে কুরআন পড়তে হাদীসে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা তারাবীহের সালাতে হাফেযদেরকে দ্রুত পড়তে বাধ্য করি। ফলে কুরআনের সাথে বেয়াদবী হয়। এছাড়া এরূপ পাঠে কুরআনের অনেক শব্দই ইমামের মুখের মধ্যে থেকে যায়, ফলে মুক্তাদিরা পুরো কুরআন শুনতে পান না। এতে কোনোভাবেই খতমের সাওয়াব পাওয়া যায় না। সুন্নাত পদ্ধতিতে তিলাওয়াত করলে হয়ত এক ঘন্টা লাগে। আর এরূপ বেয়াদবীর সাথে পড়লে হয়ত ৪০/৪৫ মিনিট লাগে। মাত্র ১৫/২০ মিনিটের জন্য আমরা অগণিত সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হই, উপরন্তু বেয়াদবির গোনাহের সমূহ সম্ভাবনা থাকে। হাযেরীন, আমাদের উদ্দেশ্য রাকাত গণনা বা খতম করেছি দাবি করা নয়, আমাদের উদ্দেশ্য সাওয়াব অর্জন। আর সাওয়াব পেতে হলে রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর নির্দেশ মতই তারাবীহের কুরআন তিলাওয়াত ও শ্রবণ করতে হবে।
হাযেরীন, তিলাওয়াত ও শ্রবন উভয় ক্ষেত্রেই কুরআনের অর্থ বুঝলেই শুধু পরিপূর্ণ সাওয়াবের আশা করা যায়। অধিকাংশ মুসলিমই না বুঝে পড়াকেই চূড়ান্ত ও পরিপূর্ণ ইবাদত বলে মনে করেন। হাযেরীন, না বুঝে তিলাওয়াত করলে হয়ত আল­াহর কালাম মুখে আউড়ানোর কিছু সাওয়াব আমরা পেতে পারি। তবে না বুঝে পড়ার জন্য তো আল­াহ কুরআন দেন নি। আল­াহ বারবার বলেছেন যে, কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য হলো যেন মানুষেরা তা বুঝে, চিন্তা করে এবং উপদেশ গ্রহণ করে। এক আয়াতে আল­াহ বলেছেন :
كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آَيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الأَلْبَابِ
‘‘এক বরকতময় কল্যাণময় গ্রন্থ আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি যেন তারা এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে।’’ সূরা সাদ: ২৯ আয়াত।
আল­াহর কিতাব পাঠ করাকে কুরআন কারীমে ‘তিলাওয়াত’ বলা হয়েছে, কারণ তিলাওয়াত অর্থ পিছে চলা বা অনুসরণ করা। শুধুমাত্র না বুঝে পাঠ করলে তিলাওয়াত হয় না। তিলাওয়াত মানে পাঠের সময় মন পঠিত বিষয়ের পিছে চলবে, এরপর জীবনটাও তার পিছে চলবে। আল­াহ বলেন:
الَّذِينَ آَتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَتْلُونَهُ حَقَّ تِلاوَتِهِ أُولَئِكَ يُؤْمِنُونَ بِهِ
“যাদেরকে আমি কিতাব প্রদান করেছি তাঁরা তা হক্কভাবে তেলাওয়াত করে, তাঁরাই এই কিতাবের উপর ঈমান এনেছে।” সূরা বাকার : ১২১
হাদীস শরীফে বারবার বলা হয়েছে যে, বুঝে পাঠের নামই হক্ক তিলাওয়াত। আর যারা এরূপ তিলাওয়াত করেন তারাই প্রকৃত ঈমানদার। বিভিন্ন হাদীসে কুরআন তিলাওয়াতের সাথে সাথে অর্থ চিন্তা করতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এমনি কোনো কোনো হাদীসে বলা হয়েছে যে, যারা কুরআনের বিভিন্ন আয়াত পাঠ করবে কিন্তু তার অর্থ নিয়ে চিন্তা করবে না তাদের জন্য শাস্তি রয়েছে। সূরা বাকার : ১২১।
আমরা অনেক সময় মনে করি, কুরআন বুঝা কঠিন কাজ, তা শুধু আলিমদের দায়িত্ব। হাযেরীন, আলিমদের দায়িত্ব কুরআনের গভীরে যেয়ে হাদীস ঘেটে ফিকহের বিধিবিধান বের করা। সাধারণ ঈমানী ও আমলী প্রেরণা নেওয়া প্রতিটি মুমিনের দায়িত্ব। আল­াহ কুরআনে চার স্থানে বলেছেন:
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآَنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ
“নিশ্চয় আমি কুরআনকে বুঝার ও উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি , কে আছে উপদেশ গ্রহণ করার ?’’ সূরা কামার : ১৭,২২,৩২, ৪০।
এরপরও আমরা যদি বলি যে, কুরআন বুঝা কঠিন তাহলে কি কুরআনকে অবজ্ঞা করা হবে না? বস্তুত কুরআন একটি অলৌকিক গ্রন্থ। এর অলৌকিকতার একটি দিক আমরা সকলে দেখতে পাই। একজন ৭/৮ বছরের অনারব শিশুও তা আগাগোড়া মুখস্থ করতে পারে। এর আরেকটি অলৌকিকত্ব হলো এর বুঝার সহজত্ব। আপনি যদি আরবী একটি শব্দ বা বাক্যও না বুঝেন, কিন্তু কুরআনের একটি অর্থানুবাদ নিয়ে আরবী আয়াত ও বাংলা অর্থ পাশাপাশি পড়ে যান, তবে আপনি দেখবেন যে, অলৌকিকভাবে অর্থটি হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছে। এভাবে দু/এক খতম পড়ার পরে আপনি যখন সালাতে দাঁড়াবেন এবং ইমামের তিলাওয়াত শুনবেন, তখন দেখবেন যে, আরবী শব্দের অর্থ না জানলেও আয়াতের অর্থটি আপনার হৃদয়ে জাগরুক হচ্ছে।
কুরআন বাদ দিয়ে সিয়াম পালন করার কারণেই আমরা প্রকৃত তাকওয়া অর্জন করতে পারছি না। রামাদানে যতটুকু আমরা কুরআন চর্চা করছি, ততটুকুও যদি বুঝে করতাম তাহলে অনেক বেশি তাকওয়া অর্জন করতে পারতাম। আমরা দিবসে তিলাওয়াতে এবং তারাবীহে, ইশা, ফজরে বা মাগরিবে ইমামের মুখে কুরআনের ভাষায় পিতামাতা, এতিম, প্রতিবেশী, দরিদ্র ও অন্যদের অধিকারের কথা, হক্ক কথা ও ইনসাফের নির্দেশ, জুলুম, মিথ্যা, ওজনে কম দেওয়া, ফাঁকি দেওয়া, গীবত করা, উপহাস করা, অহঙ্কার করা ও অন্যান্য পাপের ভয়াবহতা ইত্যাদি সবই শুনছি, কিন্তু কিছুই বুঝছি না। ফলে নামায থেকে বেরিয়ে আমরা সকল পাপ কাজই করছি। ফজর বা যোহরের পরে নিজে কুরআনে পাঠ করলাম, ওযনে কম দিলে, ফাঁকি দিলে বা প্রতারণা করলে ওয়াইল জাহান্নাম। এরপর প্রগাঢ ভক্তিতে কুরআনে চুমু দিয়ে কর্মস্থলে যেয়ে এ সকল পাপে লিপ্ত হলাম! ইন্না লিল­হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!!
আসুন, আমরা সকলেই রামাদান উপলক্ষ্যে কুরআনের তালেবে ইলম হয়ে যাই। কুরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত শিক্ষা করি এবং কুরআনের অর্থ বুঝার চেষ্টা করি। তাহলে আমরা কুরআন তিলাওয়াতের পরিপূর্ণ সাওয়াব ও বরকত ছাড়াও প্রকৃত ঈমানদার হতে পারব। আল্লাহা বলেছেন:
وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آَيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا
“যখন তাঁদের নিকট আল্লাহর আয়াতগুলি তিলাওয়াত করা হয়, তখন তাঁদের ঈমান বৃদ্ধি পায়।” সূরা আনফাল : আয়াত ২।
আমরা যদি অর্থই না বুঝি তাহলে কিভাবে আমাদের ঈমান বৃদ্ধি পাবে? আর যদি কুরআন তিলাওয়াত শুনে ঈমান বৃদ্ধি না পায় তাহলে তো প্রকৃত মুমিন হওয়া গেল না।আল্লাহ আরো বলেছেন :
اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُتَشَابِهًا مَثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ
“আল­াহ সর্বোত্তম বাণীকে সুসমঞ্জস এবং বারংবার আবৃত্তিকৃত গ্রন্থ হিসাবে অবতীর্ণ করেছেন। যারা তাদের প্রভুকে ভয় করে এই গ্রন্থ থেকে (এই গ্রন্থ পাঠ করলে বা শ্রবণ করলে) তাদের শরীর রোমাঞ্চিত ও শিহরিত হয়। অতঃপর তাদের দেহ ও মন প্রশান্ত হয়ে আল্লাহর  যিক্রের প্রতি ঝুকে পড়ে।” সূরা যুমার : আয়াত ২৩।
কুরআনের অর্থ হৃদয়ে প্রবেশ করে হৃদয়কে নাড়া না দিলে শরীর কিভাবে শিহরিত হবে? মন কিভাবে প্রশান্ত হবে? রামাদানে আমরা তারাবীহে অন্তত এক খতম কুরআন শুনি। এ সময়ে যদি কিছুটা হলেও অর্থ বুঝতে পারি তাহলে আমাদের ঈমান বৃদ্ধি পাবে এবং আমরা সত্যিকার আল্লাহ-ভীরু মুত্তাকীদের গুণাবলি অর্জন করতের পারব। হাযেরীন, আল­াহর কাছে তো এক সময় যেতেই হবে। আর কুরআন নিয়েই তার কাছে সবচেয়ে ভালভাবে যাওয়া যাবে। রাসূলুল্লাহ (সা.)  বলেছেন :
إِنَّكُمْ لاَ تَرْجِعُوْنَ إِلَى اللهِ بِشَيْءٍ أَفْضَلَ مِمَّا خَرَجَ مِنْهُ يَعْنِيْ الْقُرْآنَ
“আল­াহর কাছে ফিরে যেতে তোমাদের জন্য আল­াহর নিকট থেকে যা এসেছে তার চেয়ে, অর্থাৎ কুরআনের চেয়ে উত্তম আর কিছুই নেই।”
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.)  বলেছেন যে, যারা কুরআনের মানুষ- অর্থাৎ কুরআন পাঠ, হৃদয়ঙ্গম, প্রচার ও পালনে রত- তারাই পৃথিবীতে আল্লাহর পরিজন। আল্লাহ আমদেরকে তাঁর পরিজন হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।
পরবর্তী প্রবন্ধে আমরা সিয়ামের আহকাম সম্পর্কে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

No comments

Powered by Blogger.