শবে কদর, ইতিকাফ ও ফিতরা
রামাদানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো
শেষ দশ রাত। রাসূলুল্লাহ (সা.) রামাদানের প্রথম ২০ রাতে কিয়ামুল্লাইল করার
আগে বা পরে কিছু সময় ঘুমাতেন। কিন্তু রামাদানের শেষ দশ রাতে তিনি সারারাত
বা প্রায় সারারাত জাগ্রত থেকে কিয়ামুল্লাইল ও ইবাদতে রত থাকতেন। শুধু তাই
নয়, তিনি তাঁর পরিবার-পরিজনকেও জাগিয়ে দিতেন। আয়েশা (রা) বলেন:
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ أَحْيَا اللَّيْلَ وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ وَجَدَّ وَشَدَّ الْمِئْزَرَ
“যখন রামাদানের শেষ দশ রাত এসে যেত তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) রাত্রি জাগরিত থাকতেন, তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে জাগিয়ে দিতেন, তিনি অত্যন্ত উদ্দীপনার সাথে ইবাদত-বন্দেগিতে রত থাকতেন এবং সাংসারিক, পারিবারিক বা দাম্পত্য কাজকর্ম বন্দ করে দিতেন।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৭১১; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮৩২।
রামাদানের শেষ দশ রাতের মধ্যেই রয়েছে ‘লাইলাতুল ক্বাদ্র’ বা তাকদীর বা মর্যাদার রাত। ইমাম বাইহাকী বলেন: লাইলাতুল কাদর অর্থ হলো, এ রাত্রিতে আল্লাহ পরবর্তী বৎসরে ফিরিশতাগণ মানুষদের জন্য কি কি কর্ম করবেন তার তাকদীর বা নির্ধারণ করে দেন।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৭১১; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮৩২। সূরা কাদ্র-এ আল্লাহ বলেন:
لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ
“লাইলাতুল ক্বাদ্র এক হাজার মাস থেকেও উত্তম।”
এই রাতটি উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য সবচেয়ে বড় নেয়ামত। একটি রাতের ইবাদত এক হাজার মাস বা প্রায় ৮৪ বৎসর ইবদতের চেয়েও উত্তম। কত বড় নেয়ামত! শুধু তাই নয়, এ রাত্রি কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদে জাগ্রত থাকলে আল্লাহ পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
“যদি কেউ ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের খাঁটি নিয়্যাতে লাইলাতুল ক্বাদর কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদে অতিবাহিত করে তবে তাঁর পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৬৭২, ৭০৯; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৫২৩।
আমরা মনে করি, ২৭ শের রাতই কদরের রাত। এই চিন্তাটি সঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনোই বলেন নি যে, ২৭শে রামাদানের রাত কদরের রাত। তবে অনেক সাহাবী, তাবিয়ী বা আলিম বলেছেন যে, ২৭শের রাত শবে কদর হওয়ার সম্ভবানা বেশি। এজন্য আমাদের দায়িত্ব হলো রামাদারের শেষ দশ রাতের সবগুলি রাতকেই ‘শবে কদর’ হিসাবে ইবাদত করব। ২৭শের রাতে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ইবাদত করব।
রাসূলুল্লাহ -এর তরীকাই আমাদের জন্য সর্বোত্তম তরীকা। এতেই আমাদের নাজাত। তিনি নিজে ‘লাইলাতুল ক্বাদর’ লাভ করার জন্য রামাদানের শেষ দশরাত সবগুলিই ইবাদতের ও তাহাজ্জুদে জাগ্রত থেকেছেন এবং এরূপ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
مَنْ كَانَ مُلْتَمِسَهَا فَلْيَلْتَمِسْهَا فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ
“যদি কেউ লাইলাতুল ক্বাদর খুঁজতে চায় তবে সে যেন তা রামাদানের শেষ দশ রাত্রিতে খোঁজ করে।” মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮২৩।
এ অর্থে আরো অনেকগুলি হাদীস রয়েছে। এ সকল হাদীসে তিনি রামাদানের শেষ দশ রাত্রির সকল রাত্রিকেই শবে কদর ভেবে ইবাদত করতে বলেছেন। এক হাদীসে তিনি বলেন:
الْتَمِسُوهَا فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ فَإِنْ ضَعُفَ أَحَدُكُمْ أَوْ عَجَزَ فَلَا يُغْلَبَنَّ عَلَى السَّبْعِ الْبَوَاقِي
“তোমরা রামাদানের শেষ দশ রাত্রিতে লাইলাতুল কাদর সন্ধান করবে। যদি কেউ একান্তুই দুর্বল হয়ে পড়ে, তবে অন্তত শেষ ৭ রাতের ব্যাপারে যেন কোনোভাবেই দুর্বলতা প্রকাশ না করে।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৭১১; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮২৩।
কোনো কোনো হাদীসে তিনি বেজোড় রাত্রিগুলির বেশি গুরুত্ব দিতে বলেছেন। তিনি বলেন:
إِنِّي أُرِيتُ لَيْلَةَ الْقَدْرِ ثُمَّ أُنْسِيتُهَا أَوْ نُسِّيتُهَا فَالْتَمِسُوهَا فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ فِي الْوَتْرِ
“আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছে, অতঃপর আমাকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতএব তোমরা শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতগুলিতে তা খোঁজ করবে।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৭০৯; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮২৩।
রাসূলুল্লাহ (সা.) লাইলাতুল কাদরের উদ্দেশ্যে রামাদানের শেষ কয়েক বেজোড় রাত্রিতে সাহাবীদের নিয়ে জামাতে তারাবীহ বা কিয়ামুল্লাইল আদায় করেন। আবূ যার (রা) বলেন,
قَامَ بِنَا رَسُولُ اللَّهِ لَيْلَةَ ثَلَاثٍ وَعِشْرِينَ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ إِلَى ثُلُثِ اللَّيْلِ الأَوَّلِ ثُمَّ قَالَ لا أَحْسَبُ مَا تَطْلُبُونَ إِلاَّ وَرَاءَكُمْ ثُمَّ َقَامَ بِنَا فِي الْخَامِسَةِ (لَيْلَةَ خَمْسٍ وَعِشْرِينَ) إِلَى نِصْفِ اللَّيْلِ ثُمَّ قَالَ لا أُحْسَبُ مَا تَطْلُبُونَ إِلا وَرَاءَكُمْ ثم قُمْنَا مَعَهُ لَيْلَةَ سَبْعٍ وَعِشْرِينَ حَتَّى أَصْبَحَ (وَصَلَّى بِنَا فِي الثَّالِثَةِ وَدَعَا أَهْلَهُ وَنِسَاءَهُ فَقَامَ بِنَا حَتَّى تَخَوَّفْنَا الْفَلَاحَ قُلْتُ لَهُ وَمَا الْفَلاحُ قَالَ السُّحُورُ)
রাসূলুল্লাহ (সা.) ২৩শে রামাদানের রাত্রিতে আমাদের নিয়ে কিয়ামুল্লাইল করলেন রাত্রির এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত। এরপর বলেন, তোমরা যা খুঁজছ তা মনে হয় সামনে। এরপর ২৫শের রাত্রিতে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত কিয়াম করলেন। এরপর বলেন, তোমরা যা খুঁজছ তা বোধহয় সামনে। এরপর ২৭শের রাত্রিতে তিনি নিজের স্ত্রীগণ, পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ সবাইকে ডেকে আমাদেরকে নিয়ে প্রভাত পর্যন্ত জামাতের কিয়ামুল্লাইল করলেন, এমনকি আমরা ভয় পেয়ে গেলাম যে, সাহরী খাওয়ার সময় পাওয়া যাবে না।” তিরমিযী, আস-সুনান ৩/১৬৯; ইবনু খুযাইমা, আস-সহীহ ৩/৩৩৭; আহমদ, আল-মুসনাদ ৫/১৮০। হাদীসটি হাসান সহীহ।
আমরা অনেক সময় মনে করি তারাবীহ বা কিয়ামুল্লাইল বোধ হয় বিশ রাকাতের বেশি পড়া যায় না বা জামাতে পড়া যায় না। রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবীগণের সুন্নাত সম্পর্কে অজ্ঞতাই এর কারণ। রামাদানের কিয়ামুল্লাইল ইশার পরে বা মধ্য রাতে বা শেষ রাতে যে কোনো সময়ে ২০ রাকাত বা তার বেশি জামাতে আদায় করা যায়। সাহাবী-তাবিয়ীগণ অনেকেই শেষ দশ রাত্রিতে অতিরিক্ত ৪ বা ৮ রাকাআত কিয়ামুল্লাইল আদায় করতেন। আমাদের দায়িত্ব হলো, রামাদানের শেষ দশ রাত্রির প্রতি রাত্রিতে ইশা ও তারাবীহ-এর পরে প্রয়োজন মত কিছু সময় ঘুমিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়তে হবে। এরপর সেহেরী পর্যন্ত বাকী সময় ‘লাইলাতুল কদর’-এর নামায, তিলাওয়াত, দোয়া, দরুদ ইত্যাদি ইবাদতে সময় কাটাতে হবে। যদি মহল্লার মসজিদে কোনো ভাল হাফেজ পাওয়া যায়, তবে এ রাতগুলিতে রাত ১২/১টা থেকে ৩/৪ টা পর্যন্ত ৩/৪ ঘন্টা লম্বা কিরাআত ও দীর্ঘ রুকু সাজদা সহকারে জামাতে লাইলাতুল কাদর-এর উদ্দেশ্যে কিয়ামুল্লাইল আদায় করতে হবে এবং বেশি বেশি করে দোয়া করতে হবে। তা সম্ভব না হলে, প্রত্যেকে নিজের সুবিধা মত বেশি বেশি কিয়ামুল্লাইল বা শবে কদরের নামায আদায় করতে হবে। বেজোড় রাতগুলিকে এবং বিশেষ করে ২৭শের রাত্রি বেশি কষ্ট করতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তরীকায় সাহাবী, তাবিয়ী ও পরবর্তী বুজুর্গগণও এভাবে রামাদানের শেষ দশ রাত পালন করতেন। তাঁরা অনেকেই রামাদানের প্রথম ২০ রাতে ৩/৪ রাতে কুরআন খতম করতেন। আর শেষ দশ রাতে প্রতি রাতে ১০/১২ পারা কুরআন তিলাওয়াত করতেন নামাযের মধ্যে।
শবে কদরের জন্য রাসূলুল্লাহ একটি দুআ শিখিয়েছেন। আয়েশা (রা) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, যদি আমি লাইলাতুল কাদর পাই তাহলে আমি কি বলব? রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, তুমি বলবে:
اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ كَرِيمٌ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي
“হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমাশীল মর্যাদাময়, আপনি ক্ষমা করতে ভালবাসেন, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।” তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫৩৪; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১২৬৫। হাদীসটি হাসান সহীহ।
এ দুআটি মুখস্থ করে অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে এ দশ রাত্রির নামাযের সাজদায়, নামাযের পরে, এবং সর্বাবস্থায় বেশি বেশি করে পাঠ করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফীক দিন। আমীন।
রামাদানের শেষ দশ দিনের অন্যতম ইবাদত হলো ই’তিকাফ করা। ইতিকাফের অর্থ হলো সার্বক্ষণিকভাবে মসজিদে অবস্থান করা। ওযূ, ইসতিনজা, পানাহার ইত্যাদি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের না হওয়া। মসজিদে অবস্থানকালে ঘুমানো, বসে থাকা বা কথাবার্তা বলা যায়। তবে ইতিকাফরত অবস্থায় যথাসম্ভব চেষ্টা করতে হবে, সকল জাগতিক চিন্তা, কথাবার্তা ও মেলামেশা বাদ দিয়ে সাধ্যমত আল্লাহর যিক্র ও ইবাদত বন্দেগিতে রত থাকা। না হলে নীরব থাকা।
ই’তিকাফ মূলতই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তদুপরি লাইলাতুল কাদর-এর ফযীলত লাভের জন্যই এ সময়ে ই’তিকাফের গুরুত্ব বাড়ে। আয়েশা (রা) বলেন,
إنَّ النَّبِيَّ كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ.
“রাসূলুল্লাহ সা. রামাদান মাসের শেষ দশ দিন ই’তিকাফ করতেন। তিনি তাঁর ওফাত পর্যন্ত এভাবে ই’তিকাফ করেন। অতঃপর তাঁর স্ত্রীগণ তার পরে ই’তিকাফ করেন।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৭১৩, ৭১৯; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮৩০, ৮৩১।
আমাদের সকলেরই চেষ্টা করা দরকার রামাদানের শেষ দশদিন সুন্নাত ই’তিকাফ আদায় করার। না হলে নফল-মুস্তাহাব হিসেবে দু-এক দিনের জন্যও ই’তিকাফ করা যায়। যদি পুরো দশ দিন না পারি তবে দু-এক দিনের জন্য হলেও ই’তিকাফ করা দরকার। রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে:
مَنْ مَشَى فِيْ حَاجَةِ أَخِيْهِ كَانَ خَيْراً لَهُ مِنِ اعْتِكَافِهِ عَشْرَ سِنِيْنَ. وَمَنِ اعْتَكَفَ يَوْماً ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللهِ جَعَلَ اللهُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ النَّارِ ثَلاَثَ خَنَادِقَ كُلُّ خَنْدَقٍ أَبْعَدُ مِمَّا بَيْنَ الخَافِقَيْنِ.
“যদি কেউ তার ভাইয়ের প্রয়োজন মেটাতে হাঁটে তবে তা তার জন্য দশ বৎসর ই’তিকাফ করার চেয়েও উত্তম। আর যে ব্যক্তি একদিন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ই’তিকাফ করবে আল্লাহ তার ও জাহান্নামের মধ্যে তিনটি পরিখার দুরত্ব সৃষ্টি করবেন, প্রত্যেক পরিখার প্রশস্ততা দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি। হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/৩০০; মুনযিরী, আত-তারগীব ৩/২৬৩; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/১৯২; আলবানী, যয়ীফুত তারগীব ১/১৬৭। হাকিম, মুনযিরী ও হাইসামী হাদীসটির সনদ শক্তিশালী বলেছেন। পক্ষান্তরে ইবনুল জাওযী ও আলবানী হাদীসটিকে যয়ীফ বলেছেন।
রামাদানের শেষে যাকাতুল ফিতর আদায় করতে হয়। ইবনু আব্বাস (রা) বলেন
فَرَضَ رَسُولُ اللَّهِ زَكَاةَ الْفِطْرِ طُهْرَةً لِلصَّائِمِ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ وَطُعْمَةً لِلْمَسَاكِينِ مَنْ أَدَّاهَا قَبْلَ الصَّلاةِ فَهِيَ زَكَاةٌ مَقْبُولَةٌ وَمَنْ أَدَّاهَا بَعْدَ الصَّلاةِ فَهِيَ صَدَقَةٌ مِنَ الصَّدَقَاتِ.
“রাসূলুল্লাহ সা. যাকাতুল ফিত্র ফরয করেছেন, যেন সিয়াম পালনকারী বাজে কথা, অশ্লীল কথা (ইত্যাদি ছোটখাট অপরাধ) থেকে পবিত্রতা লাভ করে এবং দরিদ্র মানুষেরা যেন খাদ্য লাভ করে। যে ব্যক্তি সালাতুল ঈদের আগে তা আদায় করবে তার জন্য তা কবুলকৃত যাকাত বলে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি সালাতুল ঈদের পরে তা আদায় করবে, তার জন্য তা একটি সাধারণ দান বলে গণ্য হবে।” আবু দাউদ, আস-সুনান ২/১১১; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৫৮৫; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২৬৩। হাদীসটি হাসান।
আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন,
كُنَّا نُخْرِجُ زَكَاةَ الْفِطْرِ فِي زَمَانِ النَّبِيِّ صَاعًا مِنْ طَعَامٍ أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ أَوْ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ أَوْ صَاعًا مِنْ أَقِطٍ أَوْ صَاعًا مِنْ زَبِيبٍ
“রাসূলুল্লাহ সা.-এর সময়ে আমরা এক সা’ খাদ্য, অথবা এক সা যব, অথবা এক সা’ খেজুর, অথবা এক সা পনির, অথবা এক সা কিশমিশ যাকাতুল ফিতরা হিসেবে প্রদান করতাম।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৫৪৮; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৬৭৮-৬৭৯।
আসমা বিনতু আবী বাকর (রা) বলেন,
كُنَّا نُؤَدِّي زَكَاةَ الْفِطْرِ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ مُدَّيْنِ مِنْ قَمْحٍ
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে আমরা যাকাতুল ফিত্র আদায় করতাম দুই মুদ্দ গম দিয়ে। আহমদ, আল-মুসনাদ ৬/৩৫৫। হাদীসটি সহীহ। বিস্তারিত দেখুন, তাহাবী, শারহু মুশকিলিল আসার ৯/১৬-৪২।
এক সা’ হলো চার মুদ্দ। তাহলে দুই মুদ্দ হলো অর্ধ সা’। সা’-এর পরিমাপ নিয়ে ফকীগণের মতভেদ রয়েছে। ইমাম আবূ হানীফার (রাহ) মতে এক সা হলো প্রায় ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম। ইমাম আবূ ইউসূফ ও অন্য তিন ইমামের মতে এক সা’ হলো প্রায় ২ কেজি ২০০ গ্রাম।
তাহলে আমরা দেখছি যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এক সা’ খাদ্য ফিতরা দিতে বলেছেন। খেজুর, কিসমিস, পনির এবং যব এই চার প্রকার খাদ্য থেকে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম ফিতরা দিতে হবে। আর একটি বর্ণনায় আমরা দেখছি যে, গম বা আটার ক্ষেত্রে এর অর্ধেক, অর্থাৎ ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম হিসাবে ফিত্রা দিলে চলবে। আমাদের দেশে এ পাঁচ প্রকার খাদ্যের কোনোটি মূল খাদ্য নয়। এক্ষেত্রে ইসলামী মূলনীতি হলো, দান গ্রহণকারী দরিদ্রগণের সুবিধা ও কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রাখা। এ জন্য সবচেয়ে উত্তম হলো, খেজুর বা খেজুরের মূল্য প্রদান করা। কারণ সাহাবীগণ খেজুর প্রদান করতে ভালবাসতেন। এছাড়া দরিদ্রের জন্য তা অধিকতর উপকারী। তবে আমাদের দেশে সাধারণত ফিতরা-দাতাদের সুবিধার দিকে তাকিয়ে আটার মূল্য হিসেবে ফিতরা প্রদান করা হয়। এ হিসাবে বাজারের উত্তম আটা পরিবারের প্রত্যেকের পক্ষ থেকে ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম করে ফিতরা প্রদান করতে হবে। যাদের সচ্ছলতা আছে তারা মাথাপ্রতি ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম খেজুর প্রদানের চেষ্টা করবেন। এতে ফিতরা আদায় ছাড়াও রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবীগণের একটি অতিরিক্ত সুন্নাত পালন করা হবে।
ঈদের দিন নামাযের আগে অথবা তার আগে রামাদানের শেষ কয়েক দিনের মধ্যে ফিতরা আদায় করতে হবে। একজনের ফিতরা কয়েকজনকে এবং কয়েকজনের ফিতরা একজনকে দেওয়া যায়। আল্লাহ আমাদের তাঁর হুকুম সঠিক ভাবে মেনে চলার তাওফিক দিন। আমীন।
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ أَحْيَا اللَّيْلَ وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ وَجَدَّ وَشَدَّ الْمِئْزَرَ
“যখন রামাদানের শেষ দশ রাত এসে যেত তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) রাত্রি জাগরিত থাকতেন, তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে জাগিয়ে দিতেন, তিনি অত্যন্ত উদ্দীপনার সাথে ইবাদত-বন্দেগিতে রত থাকতেন এবং সাংসারিক, পারিবারিক বা দাম্পত্য কাজকর্ম বন্দ করে দিতেন।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৭১১; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮৩২।
রামাদানের শেষ দশ রাতের মধ্যেই রয়েছে ‘লাইলাতুল ক্বাদ্র’ বা তাকদীর বা মর্যাদার রাত। ইমাম বাইহাকী বলেন: লাইলাতুল কাদর অর্থ হলো, এ রাত্রিতে আল্লাহ পরবর্তী বৎসরে ফিরিশতাগণ মানুষদের জন্য কি কি কর্ম করবেন তার তাকদীর বা নির্ধারণ করে দেন।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৭১১; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮৩২। সূরা কাদ্র-এ আল্লাহ বলেন:
لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ
“লাইলাতুল ক্বাদ্র এক হাজার মাস থেকেও উত্তম।”
এই রাতটি উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য সবচেয়ে বড় নেয়ামত। একটি রাতের ইবাদত এক হাজার মাস বা প্রায় ৮৪ বৎসর ইবদতের চেয়েও উত্তম। কত বড় নেয়ামত! শুধু তাই নয়, এ রাত্রি কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদে জাগ্রত থাকলে আল্লাহ পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
“যদি কেউ ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের খাঁটি নিয়্যাতে লাইলাতুল ক্বাদর কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদে অতিবাহিত করে তবে তাঁর পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৬৭২, ৭০৯; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৫২৩।
আমরা মনে করি, ২৭ শের রাতই কদরের রাত। এই চিন্তাটি সঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনোই বলেন নি যে, ২৭শে রামাদানের রাত কদরের রাত। তবে অনেক সাহাবী, তাবিয়ী বা আলিম বলেছেন যে, ২৭শের রাত শবে কদর হওয়ার সম্ভবানা বেশি। এজন্য আমাদের দায়িত্ব হলো রামাদারের শেষ দশ রাতের সবগুলি রাতকেই ‘শবে কদর’ হিসাবে ইবাদত করব। ২৭শের রাতে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ইবাদত করব।
রাসূলুল্লাহ -এর তরীকাই আমাদের জন্য সর্বোত্তম তরীকা। এতেই আমাদের নাজাত। তিনি নিজে ‘লাইলাতুল ক্বাদর’ লাভ করার জন্য রামাদানের শেষ দশরাত সবগুলিই ইবাদতের ও তাহাজ্জুদে জাগ্রত থেকেছেন এবং এরূপ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
مَنْ كَانَ مُلْتَمِسَهَا فَلْيَلْتَمِسْهَا فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ
“যদি কেউ লাইলাতুল ক্বাদর খুঁজতে চায় তবে সে যেন তা রামাদানের শেষ দশ রাত্রিতে খোঁজ করে।” মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮২৩।
এ অর্থে আরো অনেকগুলি হাদীস রয়েছে। এ সকল হাদীসে তিনি রামাদানের শেষ দশ রাত্রির সকল রাত্রিকেই শবে কদর ভেবে ইবাদত করতে বলেছেন। এক হাদীসে তিনি বলেন:
الْتَمِسُوهَا فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ فَإِنْ ضَعُفَ أَحَدُكُمْ أَوْ عَجَزَ فَلَا يُغْلَبَنَّ عَلَى السَّبْعِ الْبَوَاقِي
“তোমরা রামাদানের শেষ দশ রাত্রিতে লাইলাতুল কাদর সন্ধান করবে। যদি কেউ একান্তুই দুর্বল হয়ে পড়ে, তবে অন্তত শেষ ৭ রাতের ব্যাপারে যেন কোনোভাবেই দুর্বলতা প্রকাশ না করে।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৭১১; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮২৩।
কোনো কোনো হাদীসে তিনি বেজোড় রাত্রিগুলির বেশি গুরুত্ব দিতে বলেছেন। তিনি বলেন:
إِنِّي أُرِيتُ لَيْلَةَ الْقَدْرِ ثُمَّ أُنْسِيتُهَا أَوْ نُسِّيتُهَا فَالْتَمِسُوهَا فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ فِي الْوَتْرِ
“আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছে, অতঃপর আমাকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতএব তোমরা শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতগুলিতে তা খোঁজ করবে।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৭০৯; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮২৩।
রাসূলুল্লাহ (সা.) লাইলাতুল কাদরের উদ্দেশ্যে রামাদানের শেষ কয়েক বেজোড় রাত্রিতে সাহাবীদের নিয়ে জামাতে তারাবীহ বা কিয়ামুল্লাইল আদায় করেন। আবূ যার (রা) বলেন,
قَامَ بِنَا رَسُولُ اللَّهِ لَيْلَةَ ثَلَاثٍ وَعِشْرِينَ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ إِلَى ثُلُثِ اللَّيْلِ الأَوَّلِ ثُمَّ قَالَ لا أَحْسَبُ مَا تَطْلُبُونَ إِلاَّ وَرَاءَكُمْ ثُمَّ َقَامَ بِنَا فِي الْخَامِسَةِ (لَيْلَةَ خَمْسٍ وَعِشْرِينَ) إِلَى نِصْفِ اللَّيْلِ ثُمَّ قَالَ لا أُحْسَبُ مَا تَطْلُبُونَ إِلا وَرَاءَكُمْ ثم قُمْنَا مَعَهُ لَيْلَةَ سَبْعٍ وَعِشْرِينَ حَتَّى أَصْبَحَ (وَصَلَّى بِنَا فِي الثَّالِثَةِ وَدَعَا أَهْلَهُ وَنِسَاءَهُ فَقَامَ بِنَا حَتَّى تَخَوَّفْنَا الْفَلَاحَ قُلْتُ لَهُ وَمَا الْفَلاحُ قَالَ السُّحُورُ)
রাসূলুল্লাহ (সা.) ২৩শে রামাদানের রাত্রিতে আমাদের নিয়ে কিয়ামুল্লাইল করলেন রাত্রির এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত। এরপর বলেন, তোমরা যা খুঁজছ তা মনে হয় সামনে। এরপর ২৫শের রাত্রিতে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত কিয়াম করলেন। এরপর বলেন, তোমরা যা খুঁজছ তা বোধহয় সামনে। এরপর ২৭শের রাত্রিতে তিনি নিজের স্ত্রীগণ, পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ সবাইকে ডেকে আমাদেরকে নিয়ে প্রভাত পর্যন্ত জামাতের কিয়ামুল্লাইল করলেন, এমনকি আমরা ভয় পেয়ে গেলাম যে, সাহরী খাওয়ার সময় পাওয়া যাবে না।” তিরমিযী, আস-সুনান ৩/১৬৯; ইবনু খুযাইমা, আস-সহীহ ৩/৩৩৭; আহমদ, আল-মুসনাদ ৫/১৮০। হাদীসটি হাসান সহীহ।
আমরা অনেক সময় মনে করি তারাবীহ বা কিয়ামুল্লাইল বোধ হয় বিশ রাকাতের বেশি পড়া যায় না বা জামাতে পড়া যায় না। রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবীগণের সুন্নাত সম্পর্কে অজ্ঞতাই এর কারণ। রামাদানের কিয়ামুল্লাইল ইশার পরে বা মধ্য রাতে বা শেষ রাতে যে কোনো সময়ে ২০ রাকাত বা তার বেশি জামাতে আদায় করা যায়। সাহাবী-তাবিয়ীগণ অনেকেই শেষ দশ রাত্রিতে অতিরিক্ত ৪ বা ৮ রাকাআত কিয়ামুল্লাইল আদায় করতেন। আমাদের দায়িত্ব হলো, রামাদানের শেষ দশ রাত্রির প্রতি রাত্রিতে ইশা ও তারাবীহ-এর পরে প্রয়োজন মত কিছু সময় ঘুমিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়তে হবে। এরপর সেহেরী পর্যন্ত বাকী সময় ‘লাইলাতুল কদর’-এর নামায, তিলাওয়াত, দোয়া, দরুদ ইত্যাদি ইবাদতে সময় কাটাতে হবে। যদি মহল্লার মসজিদে কোনো ভাল হাফেজ পাওয়া যায়, তবে এ রাতগুলিতে রাত ১২/১টা থেকে ৩/৪ টা পর্যন্ত ৩/৪ ঘন্টা লম্বা কিরাআত ও দীর্ঘ রুকু সাজদা সহকারে জামাতে লাইলাতুল কাদর-এর উদ্দেশ্যে কিয়ামুল্লাইল আদায় করতে হবে এবং বেশি বেশি করে দোয়া করতে হবে। তা সম্ভব না হলে, প্রত্যেকে নিজের সুবিধা মত বেশি বেশি কিয়ামুল্লাইল বা শবে কদরের নামায আদায় করতে হবে। বেজোড় রাতগুলিকে এবং বিশেষ করে ২৭শের রাত্রি বেশি কষ্ট করতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তরীকায় সাহাবী, তাবিয়ী ও পরবর্তী বুজুর্গগণও এভাবে রামাদানের শেষ দশ রাত পালন করতেন। তাঁরা অনেকেই রামাদানের প্রথম ২০ রাতে ৩/৪ রাতে কুরআন খতম করতেন। আর শেষ দশ রাতে প্রতি রাতে ১০/১২ পারা কুরআন তিলাওয়াত করতেন নামাযের মধ্যে।
শবে কদরের জন্য রাসূলুল্লাহ একটি দুআ শিখিয়েছেন। আয়েশা (রা) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, যদি আমি লাইলাতুল কাদর পাই তাহলে আমি কি বলব? রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, তুমি বলবে:
اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ كَرِيمٌ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي
“হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমাশীল মর্যাদাময়, আপনি ক্ষমা করতে ভালবাসেন, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।” তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫৩৪; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১২৬৫। হাদীসটি হাসান সহীহ।
এ দুআটি মুখস্থ করে অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে এ দশ রাত্রির নামাযের সাজদায়, নামাযের পরে, এবং সর্বাবস্থায় বেশি বেশি করে পাঠ করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফীক দিন। আমীন।
রামাদানের শেষ দশ দিনের অন্যতম ইবাদত হলো ই’তিকাফ করা। ইতিকাফের অর্থ হলো সার্বক্ষণিকভাবে মসজিদে অবস্থান করা। ওযূ, ইসতিনজা, পানাহার ইত্যাদি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের না হওয়া। মসজিদে অবস্থানকালে ঘুমানো, বসে থাকা বা কথাবার্তা বলা যায়। তবে ইতিকাফরত অবস্থায় যথাসম্ভব চেষ্টা করতে হবে, সকল জাগতিক চিন্তা, কথাবার্তা ও মেলামেশা বাদ দিয়ে সাধ্যমত আল্লাহর যিক্র ও ইবাদত বন্দেগিতে রত থাকা। না হলে নীরব থাকা।
ই’তিকাফ মূলতই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তদুপরি লাইলাতুল কাদর-এর ফযীলত লাভের জন্যই এ সময়ে ই’তিকাফের গুরুত্ব বাড়ে। আয়েশা (রা) বলেন,
إنَّ النَّبِيَّ كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ.
“রাসূলুল্লাহ সা. রামাদান মাসের শেষ দশ দিন ই’তিকাফ করতেন। তিনি তাঁর ওফাত পর্যন্ত এভাবে ই’তিকাফ করেন। অতঃপর তাঁর স্ত্রীগণ তার পরে ই’তিকাফ করেন।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৭১৩, ৭১৯; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮৩০, ৮৩১।
আমাদের সকলেরই চেষ্টা করা দরকার রামাদানের শেষ দশদিন সুন্নাত ই’তিকাফ আদায় করার। না হলে নফল-মুস্তাহাব হিসেবে দু-এক দিনের জন্যও ই’তিকাফ করা যায়। যদি পুরো দশ দিন না পারি তবে দু-এক দিনের জন্য হলেও ই’তিকাফ করা দরকার। রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে:
مَنْ مَشَى فِيْ حَاجَةِ أَخِيْهِ كَانَ خَيْراً لَهُ مِنِ اعْتِكَافِهِ عَشْرَ سِنِيْنَ. وَمَنِ اعْتَكَفَ يَوْماً ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللهِ جَعَلَ اللهُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ النَّارِ ثَلاَثَ خَنَادِقَ كُلُّ خَنْدَقٍ أَبْعَدُ مِمَّا بَيْنَ الخَافِقَيْنِ.
“যদি কেউ তার ভাইয়ের প্রয়োজন মেটাতে হাঁটে তবে তা তার জন্য দশ বৎসর ই’তিকাফ করার চেয়েও উত্তম। আর যে ব্যক্তি একদিন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ই’তিকাফ করবে আল্লাহ তার ও জাহান্নামের মধ্যে তিনটি পরিখার দুরত্ব সৃষ্টি করবেন, প্রত্যেক পরিখার প্রশস্ততা দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি। হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/৩০০; মুনযিরী, আত-তারগীব ৩/২৬৩; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/১৯২; আলবানী, যয়ীফুত তারগীব ১/১৬৭। হাকিম, মুনযিরী ও হাইসামী হাদীসটির সনদ শক্তিশালী বলেছেন। পক্ষান্তরে ইবনুল জাওযী ও আলবানী হাদীসটিকে যয়ীফ বলেছেন।
রামাদানের শেষে যাকাতুল ফিতর আদায় করতে হয়। ইবনু আব্বাস (রা) বলেন
فَرَضَ رَسُولُ اللَّهِ زَكَاةَ الْفِطْرِ طُهْرَةً لِلصَّائِمِ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ وَطُعْمَةً لِلْمَسَاكِينِ مَنْ أَدَّاهَا قَبْلَ الصَّلاةِ فَهِيَ زَكَاةٌ مَقْبُولَةٌ وَمَنْ أَدَّاهَا بَعْدَ الصَّلاةِ فَهِيَ صَدَقَةٌ مِنَ الصَّدَقَاتِ.
“রাসূলুল্লাহ সা. যাকাতুল ফিত্র ফরয করেছেন, যেন সিয়াম পালনকারী বাজে কথা, অশ্লীল কথা (ইত্যাদি ছোটখাট অপরাধ) থেকে পবিত্রতা লাভ করে এবং দরিদ্র মানুষেরা যেন খাদ্য লাভ করে। যে ব্যক্তি সালাতুল ঈদের আগে তা আদায় করবে তার জন্য তা কবুলকৃত যাকাত বলে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি সালাতুল ঈদের পরে তা আদায় করবে, তার জন্য তা একটি সাধারণ দান বলে গণ্য হবে।” আবু দাউদ, আস-সুনান ২/১১১; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৫৮৫; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২৬৩। হাদীসটি হাসান।
আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন,
كُنَّا نُخْرِجُ زَكَاةَ الْفِطْرِ فِي زَمَانِ النَّبِيِّ صَاعًا مِنْ طَعَامٍ أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ أَوْ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ أَوْ صَاعًا مِنْ أَقِطٍ أَوْ صَاعًا مِنْ زَبِيبٍ
“রাসূলুল্লাহ সা.-এর সময়ে আমরা এক সা’ খাদ্য, অথবা এক সা যব, অথবা এক সা’ খেজুর, অথবা এক সা পনির, অথবা এক সা কিশমিশ যাকাতুল ফিতরা হিসেবে প্রদান করতাম।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৫৪৮; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৬৭৮-৬৭৯।
আসমা বিনতু আবী বাকর (রা) বলেন,
كُنَّا نُؤَدِّي زَكَاةَ الْفِطْرِ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ مُدَّيْنِ مِنْ قَمْحٍ
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে আমরা যাকাতুল ফিত্র আদায় করতাম দুই মুদ্দ গম দিয়ে। আহমদ, আল-মুসনাদ ৬/৩৫৫। হাদীসটি সহীহ। বিস্তারিত দেখুন, তাহাবী, শারহু মুশকিলিল আসার ৯/১৬-৪২।
এক সা’ হলো চার মুদ্দ। তাহলে দুই মুদ্দ হলো অর্ধ সা’। সা’-এর পরিমাপ নিয়ে ফকীগণের মতভেদ রয়েছে। ইমাম আবূ হানীফার (রাহ) মতে এক সা হলো প্রায় ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম। ইমাম আবূ ইউসূফ ও অন্য তিন ইমামের মতে এক সা’ হলো প্রায় ২ কেজি ২০০ গ্রাম।
তাহলে আমরা দেখছি যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এক সা’ খাদ্য ফিতরা দিতে বলেছেন। খেজুর, কিসমিস, পনির এবং যব এই চার প্রকার খাদ্য থেকে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম ফিতরা দিতে হবে। আর একটি বর্ণনায় আমরা দেখছি যে, গম বা আটার ক্ষেত্রে এর অর্ধেক, অর্থাৎ ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম হিসাবে ফিত্রা দিলে চলবে। আমাদের দেশে এ পাঁচ প্রকার খাদ্যের কোনোটি মূল খাদ্য নয়। এক্ষেত্রে ইসলামী মূলনীতি হলো, দান গ্রহণকারী দরিদ্রগণের সুবিধা ও কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রাখা। এ জন্য সবচেয়ে উত্তম হলো, খেজুর বা খেজুরের মূল্য প্রদান করা। কারণ সাহাবীগণ খেজুর প্রদান করতে ভালবাসতেন। এছাড়া দরিদ্রের জন্য তা অধিকতর উপকারী। তবে আমাদের দেশে সাধারণত ফিতরা-দাতাদের সুবিধার দিকে তাকিয়ে আটার মূল্য হিসেবে ফিতরা প্রদান করা হয়। এ হিসাবে বাজারের উত্তম আটা পরিবারের প্রত্যেকের পক্ষ থেকে ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম করে ফিতরা প্রদান করতে হবে। যাদের সচ্ছলতা আছে তারা মাথাপ্রতি ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম খেজুর প্রদানের চেষ্টা করবেন। এতে ফিতরা আদায় ছাড়াও রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবীগণের একটি অতিরিক্ত সুন্নাত পালন করা হবে।
ঈদের দিন নামাযের আগে অথবা তার আগে রামাদানের শেষ কয়েক দিনের মধ্যে ফিতরা আদায় করতে হবে। একজনের ফিতরা কয়েকজনকে এবং কয়েকজনের ফিতরা একজনকে দেওয়া যায়। আল্লাহ আমাদের তাঁর হুকুম সঠিক ভাবে মেনে চলার তাওফিক দিন। আমীন।
No comments